প্রশান্ত ভূষণ।
প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে তাঁর করা দু’টি টুইটে বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আদালত অবমাননা করেছেন বলে শুক্রবার রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। এই অপরাধের জন্য ২০ তারিখে ভূষণকে শাস্তি দেবে বিচারপতি অরুণ মিশ্র, বিচারপতি বি আর গাভাই এবং বিচারপতি কৃষ্ণ মুরারীর বেঞ্চ। তবে টুইটার সংস্থার জবাবে সন্তোষ প্রকাশ করে অভিযুক্তের তালিকা থেকে তাদের বাদ দিয়েছেন বিচারপতিরা।
প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মোটরবাইকে চড়ে রয়েছেন— এমন একটি ছবি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। সর্বোচ্চ আদালতের কাজকর্ম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ভূষণ টুইটে লেখেন, এ সব দিকে নজর না-দিয়ে প্রধান বিচারপতি দামী মোটরবাইকে চড়ছেন। তাঁর মাথায় হেলমেট নেই কেন, সেই প্রশ্নও তোলেন ভূষণ। এর পরে আর একটি টুইটেও সর্বোচ্চ আদালতের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এই আইনজীবী। প্রধান বিচারপতি পরে বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর সুপারবাইকের প্রতি আকর্ষণ। একটি শোরুমের সামনে নতুন এই বাইকটি গ্রাহকদের প্রদর্শনের জন্য রাখা দেখে তিনি চড়ে বসেছিলেন। বিচারপতি বোবদে ব্যাখ্যা দেন, বাইকটির সুইচ বন্ধ ছিল। ছবিতেও দেখা যাচ্ছে, সেটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো। তাই চালানোর প্রশ্নই নেই। সুতরাং হেলমেট পরার প্রশ্নও ওঠে না।
ভূষণ শুনানির সময়ে যুক্তি দেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকারের বলেই তিনি টুইটে নিজের কথা বলেছেন। এর ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা পড়েনি, আদালতের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়নি। তাই নিজের টুইটে যা বলেছেন, তা থেকে সরবেন না। প্রধান বিচারপতির যুক্তি মেনে বক্তব্যের ওই অংশটুকুই শুধু প্রত্যাহার করতে পারেন, যেখানে হেলমেট না-পরার কথা বলা রয়েছে। ভূষণ তাঁর সওয়ালে বলেন, আদালত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি স্তম্ভ। তার ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরা মানেই সেটা আদালত অবমাননা করা নয়। আদালতকেও সমালোচনা গ্রহণ করতে হবে। কোনও বিচারপতির বালখিল্য কাজের সমালোচনা করাটা সামগ্রিক ভাবে যে বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিপ্রায় নয়, সেটা মানতে হবে।
আরও পড়ুন: অমিতের করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছে, বিচার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের শুধু একটি স্তম্ভই নয়, প্রধান স্তম্ভ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে ধরে রাখে আদালত ও বিচারব্যবস্থা। তাই বিচারপতি ও আদালতের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণের সামিল। ভূষণের মতো অভিজ্ঞ আইনজীবীর কাছে তা আশা করা যায় না। তিনি আদালত অবমাননা করেছেন।
তবে টুইটার কর্তৃপক্ষ যে জবাব দিয়েছে, তাতে বিচারপতিরা সন্তুষ্ট বলে জানিয়ে তাঁদের ছাড় দিয়েছেন। টুইটার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, কোটি কোটি ব্যবহারকারী কে কী পোস্ট করছে, সেটা যাচাই করে সম্পাদনা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। যিনি লিখছেন, আইনভঙ্গের দায়ও তাঁরই হওয়া উচিত।
এই রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন’-এর তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। অনেকেই এখন মনে করেন, দেশের অন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিরোধীদের অপরাধী তকমা দিচ্ছে। তাঁরা এও মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টও এখন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কোনও গুরুতর প্রশ্নকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এই রায়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গিই আরও জোরদার হবে।’’ এই প্রসঙ্গে সংগঠনটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের চার প্রবীণ বিচারপতির সাংবাদিক বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। সেখানে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের সঙ্গে নিজেদের মতবিরোধের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন ওই চার বিচারপতি। ‘সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন’-এর বক্তব্য, ‘‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতির কথা বলেছিলেন ওই চার বিচারপতি। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওই নীতিগুলি মেনে চলা হচ্ছে না।’’
প্রায় একই সুর ইন্দিরা জয়সিংহ, সঞ্জয় হেগড়ের মতো আইনজীবীদের। জয়সিংহের মতে, ‘‘বাক্স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’’
টুইটারে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের প্রশ্ন, ‘‘আমাদের রক্ষা করা যাঁদের কাজ, কেন তাঁদের গাত্রচর্ম এত পাতলা হবে?’’ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির মতে, ‘‘সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার ন্যায্য সমালোচনাও এ বার অবমাননার গণ্ডিতে পড়বে।’’