তিনি কি সুকুমার রায়ের ‘গেছোদাদা’? নাকি কংগ্রেসের কিছু নেতার বিশ্লেষণই ঠিক! যাঁরা খেদের সঙ্গে বলছেন, “বোঝে না সে বোঝে না! কখন কী করা উচিত, ওঁর তালজ্ঞান নেই!”
রাহুল গাঁধীর কথা হচ্ছে।
গত ৩০ অক্টোবরের কথাই ধরুন। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব তখন ঘোর আশঙ্কায়। ঠিক পরের দিন ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুবার্ষিকী। অথচ সেই দিনটাতেই মহা সমারোহে বল্লভভাই পটেলের জন্মদিন পালন করতে চলেছে মোদী সরকার। এ কি ইন্দিরা-স্মরণকে ঢেকে দেওয়ার কৌশল? বৈঠক বসল দশ জনপথে। ভাবা হয়েছিল, দলের সহ-সভাপতিও আছেন বুঝি বৈঠকে! কিন্তু কোথায় তিনি? খোঁজ খোঁজ! জানা গেল, রাহুল গিয়েছেন দিল্লির প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে, রাজ্য রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে!
শুধু ৩০ অক্টোবর নয়, পরপর অনেকগুলো ঘটনা। আর সে সময় অকুস্থলে রাহুলের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক বিবেচনা বোধও এখন প্রশ্নের মুখে। এবং এ ব্যাপারে কংগ্রেসের অন্দরমহলেও অসন্তোষ ক্রমশই বাড়ছে।
গত বছর উত্তরাখণ্ডে নেমে এল বিধ্বংসী হড়পা বান। অনেক মৃত্যু। কংগ্রেস শাসিত রাজ্য, অথচ গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পৌঁছে গেলেন দেহরাদূনে। গুজরাতি পর্যটকদের উদ্ধার করে নিয়ে এলেন আমদাবাদে। রাহুল তখন কোথায়? জানা গেল, তিনি রয়েছেন বিলেতে। জন্মদিনের ছুটি কাটাচ্ছেন। তা নিয়ে শোরগোল হতে কংগ্রেস জানাল, “বিলেতে বসেই রাহুল সব ‘মনিটর’ করছেন। তাঁর নির্দেশেই যুব কংগ্রেসের কর্মীরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন উত্তরাখণ্ডে।”
পরের ঘটনা। লোকসভা ভোটের পর কংগ্রেসের সদর দফতরে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সম্মানে নৈশভোজ। ইউপিএ মন্ত্রিসভার সকলেই রয়েছেন। ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্য ও শীর্ষ নেতারা রয়েছেন। অথচ দলের তরুণ কান্ডারি নেই। কেন নেই? এ বারও তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেল, রাহুল দেশেই নেই। এমনিতে গাঁধী পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখে এসপিজি। তবু খবর মিলল, ভোটের প্রচার করে ক্লান্ত রাহুল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও এক সৈকতাবাসে ক’দিনের ‘ব্রেক’ নিচ্ছেন। নৈশভোজ শেষ হতে না হতেই কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গেল মিডিয়ায়। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস জানাল, অপারগতার জন্য রাহুল আগাম ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন মনমোহনের কাছে।
সে-ও না হয় গেল। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ ফাঁস করে দিতে সম্প্রতি দিল্লির যন্তর-মন্তরে যুব কংগ্রেস সমর্থকদের প্রতিবাদী জমায়েতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাহুল। কলকাতা থেকে যুব কংগ্রেসের কিছু নেতা তার জন্য অতি উৎসাহে কালো টি-শার্ট ছাপিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত দিনে দেখা গেল, প্রতিবাদ সভায় রাহুলই গরহাজির! ফের সমালোচনা। অবশেষে প্রতিবাদীরা যখন পুলিশের লাঠি খেলেন, তখন রাহুল এলেন। তা-ও যন্তর-মন্তরে নয়, যুব কংগ্রেসের দফতরে।
এবং মহারাষ্ট্র-হরিয়ানায় ভোটের ফল ঘোষণার দিন। কংগ্রেসের বিপর্যয় নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে দিতে ঘাম ছুটছে দলের নেতাদের। ২৪ আকবর রোড দৃশ্যত নেতিয়ে পড়েছে। দশ জনপথে সনিয়া গাঁধী বর্ষীয়ান নেতাদের ডেকে আলোচনা করছেন। এবং ফের রাহুল নেই। টুইটারে আছড়ে পড়ছে প্রশ্ন ‘হোয়্যার ইজ রাহুল?’ দল জানাল, তিনি দু’দিনের জন্য বিশাখাপত্তনমে গিয়েছেন। হুদহুদ আক্রান্তদের সঙ্গে দেখা করতে। পরে বিকেলে টেক্সট মেসেজে তাঁর প্রতিক্রিয়া এল।
কেন এমন অধরা রাহুল? পরিস্থিতির গুরুত্ব কি তিনি অনুধাবন করেন না? এ প্রসঙ্গে কারও কারও ব্যাখ্যা একেবারে চাঁছাছোলা। তাঁদের মতে, রাহুল আসলে পোড় খাওয়া রাজনীতিক এখনও হয়ে উঠতে পারেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ রাজনীতির নাড়ির স্পন্দনটাই তিনি ঠাওর করতে পারছেন না। ব্যর্থতা রয়েছে তাঁর পরামর্শদাতাদেরও। যাঁদের সঙ্গে মাটির রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই, রাহুল তাঁদেরই পরামর্শে চলছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কংগ্রেসেরই এক বর্ষীয়ান নেতা যেমন কিছুটা রাগত স্বরে বললেন, “ব্যক্তিগত ভাবে হয়তো উনিও (রাহুল) সিরিয়াস নন। নইলে মনমোহনের বিদায়ী নৈশভোজে দলের সহ-সভাপতি থাকবেন না, এটা হতেই পারে না। এটুকু বিবেচনার জন্য কোনও পরামর্শদাতার প্রয়োজন হয় না।” আর এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “ওঁকে কে বোঝাবে! রাহুল মনে করছেন, তিনি যা করছেন সেটাই ঠিক। রাজনীতিতে কোনও রকম ভেক ধরা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু সেটাও যে রাজনীতির অঙ্গ, তা মোদীকে দেখেও শিখছেন না।”
এমনকী মাঝেমধ্যেই রাহুলের জন্য গলা ফাটানো দিগ্বিজয় সিংহ পর্যন্ত ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে দিন যন্তর-মন্তরে হাজির না হয়ে ঠিক করেননি কংগ্রেস সহ-সভাপতি। তাঁর কথায়, “রাহুলের উচিত এখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। রাস্তায় নেমে রাজনীতি করা। দরকার হলে লাঠিও খেতে হবে নেতাদের। আমিও সে জন্য প্রস্তুত।” যদিও এই প্রতিটি অভিযোগেরই পাল্টা যুক্তি রয়েছে টিম রাহুলের। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেনের বক্তব্য, “রাহুল গাঁধী দায়িত্বশীল নেতা। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ভোট হয়ে গিয়েছে। ফল প্রকাশের জন্য দিল্লিতে বসে থাকার চেয়ে ওঁর ঘূর্ণিঝড় পীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোটা বেশি জরুরি ছিল।” আর এক নেতার ব্যাখ্যা, নেতিবাচক পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে নতুন করে শক্তি পাওয়া যায়। এখন দরকার সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। রাহুল সেটাই করছেন। অযথা শক্তিক্ষয় না করে ঠিক সময়ে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন তিনি।
টিম রাহুলের আর এক সদস্য জিতেন্দ্র সিংহ গোটা বিষয়টায় সংবাদমাধ্যমকেই দুষছেন। তাঁর কথায়, “লোকসভা ভোটের প্রচারের পর শরদ পওয়ার, চন্দ্রবাবু নায়ডু থেকে শুরু করে বহু নেতা ছুটি কাটাতে বাইরে গিয়েছিলেন। আসলে সংবাদমাধ্যম এখন এক চোখে দেখছে! তাই রাহুলের ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছে।” এমনকী যন্তর-মন্তরে রাহুলের অনুপস্থিতির পক্ষেও সওয়াল করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, ওই রকম খোলামেলা জায়গায় দুম করে চলে যাওয়া রাহুলের পক্ষে বিপজ্জনক। তা ছাড়া, মোদী সরকারের তো সবে কয়েক মাস কেটেছে। রাহুল যদি এখনই বিরোধিতায় রাস্তায় নামেন, পরে কী করবেন!
তা হলে, রাহুলই কি ঠিক? কে জানে! তবে সমস্যা হল, তাঁর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি, স্থান-কাল বিবেচনা নিয়ে কাটাছেঁড়াটা বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই!