টিপু সুলতানের ছোট ছেলে গোলাম মহম্মদের উত্তরপুরুষ আনোয়ার আলি। ফাইল চিত্র।
টিপু সুলতানকে নিয়ে অপপ্রচারে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হতে তাঁরও খোঁজ পড়েছিল। কর্নাটকে নানা টিভি চ্যানেলের আলোচনায় বার বার ডাক পেয়েছেন আনোয়ার আলি। দক্ষিণ কলকাতায় নিউ আলিপুরের বাসিন্দা মধ্য চল্লিশের যুবক তাঁদের সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপুর ছোট ছেলে গোলাম মহম্মদের উত্তরপুরুষ রবিবার বলছিলেন, “যা হচ্ছিল তাতে খারাপ তো লাগতই! তবে ইচ্ছে করেই টিপু সুলতানকে টেনে রাজনীতির নোংরামিতে ঢুকতে চাইনি।”
তবে কর্নাটকের ভোট-ফলে টিপুর নামে রাজনীতিরও পরিণাম দেখছেন অনেকেই। ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধের নায়ক টিপুকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ তকমা দিয়ে অন্য রকম রাজনীতি শুরু করে বিজেপি। গিরিশ কারনাডের ‘টিপু সুলতানের স্বপ্ন’ নাটকটিকে ব্যঙ্গ করে ‘টিপু সুলতানের আসল স্বপ্ন’ বলে বিকৃত নাট্য-কাহিনি লেখানো হয়। যা সরকারি উদ্যোগে অভিনীতও হচ্ছিল।
বিজেপি নেতারা অনেকেই কর্নাটকে ভোটপ্রচারে টিপুকে নিয়মিত কলঙ্কিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ কর্নাটকে প্রভাবশালী কৃষক গোষ্ঠী ভোক্কালিগাদের ভোট টানতে টিপুর মৃত্যু নিয়েও গল্প ফাঁদে বিজেপি শিবির। ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধে টিপুর মৃত্যুবরণের কাহিনি পাল্টে টিপুর দু’জন কাল্পনিক আততায়ী উরি গৌড়া এবং নানজে গৌড়ার কাহিনি চালু করা হয়। মহীশূরের সুলতান টিপুকে কেরলের মালাবার ও কর্নাটকের কয়েকটি এলাকায় হামলাবাজ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, আসলে ব্রিটিশরা নয়, উরি গৌড়া, নানজে গৌড়ারাই টিপুকে হত্যা করেছিলেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সি টি রবি এবং দুই মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে গত মার্চেই ছবি তৈরিরও তোড়জোড় করছিলেন। কিন্তু ভোক্কালিগাদের বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ধর্মগুরু নির্মলানন্দনাথ স্বামী তাতে ক্ষুব্ধ হন।
টিপু সুলতান গবেষক তথা লেখক নিধিন ওলিকারা বা টিপুর স্মৃতিজড়িত মাইসুরুর বাসিন্দা, লেখক টি গুরুরাজের মত, “ব্রিটিশ আমলে টিপু সুলতানের হত্যাকারী পরিচয়ে ভোক্কালিগারা গৌরবের কিছু দেখেননি। তাঁরা এতে ক্ষুব্ধই হন। বিজেপি ভেবেছিল টিপুর মৃত্যু নিয়ে গল্প ফেঁদে দক্ষিণ কর্নাটকে ভোক্কালিগাদের কাছে টানা যাবে। হয়েছে উল্টোটা! ওই তল্লাটে বিজেপির ভরাডুবি।” ইতিহাসবিদ অমিত দে-ও মনে করেন, “টিপু সুলতানের রাজ্যে সমন্বয়ী সংস্কৃতির নানা চিহ্ন মিলেছে। টিপুর দেওয়ান হিন্দু ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের সব মুসলিম শাসককেই খলনায়ক বানিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ঘটানোর রাজনীতি বিজেপির সাধারণ কর্মসূচি। কর্নাটকে টিপুর ভাবমূর্তি নষ্ট করতেও তাই বিজেপি মিথ্যারই আশ্রয় নিয়েছে।”
বিজেপি আমলে কর্নাটকে ইতিহাস বইয়েও টিপুর ভূমিকা ছাঁটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। টিপুর পুত্র ইয়াসিন সুলতানের উত্তরপুরুষ কলকাতাবাসী ইসমাইল আলির ভগ্নিপতি সৈয়দ মনসুর কর্নাটকে টিপু-অনুরাগী তেহরিক-ই-খুদাদাদ মঞ্চের আহ্বায়ক। তিনি এবং বিভিন্ন ধর্ম নির্বিশেষে টিপু-অনুরাগীরা চান, ‘মহীশূরের গৌরব’ যেন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পান। টিপু-পুত্র গোলাম মহম্মদের সপ্তম প্রজন্ম কলকাতার মার্বেল ব্যবসায়ী আনোয়ার আলিও টিপু-অনুরাগীদের আমন্ত্রণে কর্নাটকে গিয়েছেন। টিপুর মৃত্যুর পরে নাবালক গোলাম মহম্মদ-সহ পরিজনেরা অনেকেই কলকাতায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। এ শহরের সমাজজীবনে টালিগঞ্জ এলাকায় নানা অবদান পরিবারটির। বাড়িতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বাবার ছবি দেখাতে দেখাতে টিপুর উত্তরপুরুষ বললেন, “টিপু সুলতানকে নিয়ে অপপ্রচারে কষ্ট পেলেও আমরা অবাক নই! গান্ধীর আততায়ী গডসেকেও আজকাল নায়ক করা হচ্ছে। মিথ্যেয় টিপু সুলতানের আত্মবলিদান ইতিহাস থেকে মোছা যাবে না।”