Stock price

অর্থনীতি ধুঁকছে, অথচ শেয়ার বাজারে টাকা উড়ছে কী করে!

বাজারে নগদ জোগান বাড়ছে কিন্তু তা কুক্ষিগত হয়ে থাকছে কয়েকজনের হাতে। আর তা থাকছে এমন কিছু মানুষের হাতে যাদের হাতের নগদ সঞ্চয় বাজারের চাহিদা না বাড়িয়ে, দৌড়চ্ছে সোনা আর শেয়ার বাজারের দিকে।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:৫২
Share:

অর্থনীতি ধুঁকলেও শেয়ার বাজারের সূচক উপরের দিকেই। ফাইল চিত্র।

একদিকে হাহাকার আর অন্যদিকে নগদের ছড়াছড়ি। একদিকে শেয়ার সূচক নীচে নামবে না বলছে, আর অন্যদিকে চাকরির বাজারে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরছে প্রার্থীর দল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসও শেয়ার বাজারের এই চড়া সূচক নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। আর এই সংঘাত যেমন অর্থনীতির ভিত নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, তেমনই বাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নিয়েও সংশয়ের জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

Advertisement

সমস্যাটা এখানেই। বাজারে নগদ জোগান বাড়ছে কিন্তু তা কুক্ষিগত হয়ে থাকছে কয়েকজনের হাতে। আর তা থাকছে এমন কিছু মানুষের হাতে যাদের হাতের নগদ সঞ্চয় বাজারের চাহিদা না বাড়িয়ে, দৌড়চ্ছে সোনা আর শেয়ার বাজারের দিকে। সরকার যে তা জানে না তা নয়। শক্তিকান্তবাবু এই পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্তব্যে বলেছেন, “বাজারে এত নগদের জোগান,... তাই শেয়ার বাজারের সূচকও উপরের দিকেই নড়াচড়া করছে। এর সঙ্গে বাজারের বাস্তবের কোনও মিল নেই।... সূচকের সঙ্গে বাজারের বাস্তবের তালমিল হবেই। তবে তা কবে তা আমি বলতে পারব না।”

একশ শব্দ যা বলে এক ছবিতেই তা বলা যায়। তাই শক্তিকান্ত দাসের দুশ্চিন্তা বুঝতে চোখ রাখা যাক নীচের দুই রেখাচিত্রে।

Advertisement

কোভিডের আগে থেকেই কিন্তু বাজারের এই চিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে চলেছেন নীতি আলোচকরা। গত পাঁচ মাসেও কিন্তু এই দৌড় থামেনি। এপ্রিল থেকে অগস্ট মাসের মধ্যে এনএসই নিফটি ৫০ আর বিএসই সেনসেক্স যখাক্রমে ৩৭.১ শতাংশ এবং ৩৫.২ শতাংশ বেড়েছে। বেড়েছে এমন সময়, যখন দেশ জুড়ে উৎপাদন বন্ধ, একের পর এক সংস্থা বাধ্য হয়ে ছাঁটাইয়ের রাস্তায় হেঁটেছে! সাধারণ কথায় বললে, একদিকে দেশের অর্থনীতির সংকোচন অব্যাহত, অন্যদিকে শেয়ার বাজারে টাকা উড়ছে।

আমরা জানি যে ভারতে জিডিপির ৭০ শতাংশই আসে দেশের বাজারের চাহিদা থেকে। আর বিগত পাঁচ বছর ধরেই নীতি আলোচকরা বলছেন, বৃদ্ধির অধঃগতির মূলে রয়েছে চাহিদার ঘাটতি। উপায় হিসাবে সাধারণের হাতে যাতে নগদের জোগান বাড়ে তার ব্যবস্থা করার উপরে জোর দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু কেন্দ্র যে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে তা কিন্তু পরিষ্কার শেয়ার সূচকের চল থেকেই। দেশে যে নগদের জোগানের অভাব নেই তা তো শেয়ার সূচকের অবস্থান থেকেই পরিষ্কার। তা হলে? এখানেও বোধহয় সমস্যাটা ওই আর্থিক অসাম্যের।

শক্তিকান্ত দাস যাই বলুন না কেন, সরকারের নীতিতে কিন্তু এই উপলব্ধির কোনও প্রতিফলন নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২০-র বার্ষিক রিপোর্ট কী বলছে তা একবার দেখা যাক। “দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পতন অনেকটাই রোখা গিয়েছিল সপ্তম পে কমিশন ও এক রাঙ্ক এক পেনশনের সিদ্ধান্তের কারণে দেশের বাজারে চাহিদা বাড়ায়।” দেশের চাকুরিজীবীদের একটা বড় অংশ সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োজিত। তাই তাদের মাইনে বাড়লে দেশের বাজারেও তার অভিঘাত পড়ে চাহিদার মাধ্যমে।

অর্থাৎ, অন্যভাবে দেখলে, বাজারে চাহিদার ঘাটতিই যদি আর্থিক বৃদ্ধির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে চাহিদা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তা করতে গেলে সরকারি খরচকে এমন ভাবে সাজাতে হবে, যাতে যাঁদের হাতে তুলনামূলক ভাবে সম্পদ কম তাঁদের হাতে নগদের জোগান বাড়াতে হবে। যাঁদের প্রচুর আছে তাঁদের হাতে নগদ গেলে তা কিন্তু তুলনামূলক ভাবে বাজারে আসবে কম।

শেয়ার সূচক কিন্তু এই যুক্তিই প্রমাণ করছে। বাজারে নগদের জোগান যে আছে তা শীর্ষ ব্যাঙ্কই বলছে। কিন্তু তা দেশের বাড়তে থাকা আয়ের অসাম্যের কারণে পণ্যের যথাযথ চাহিদা বাড়ানোর বদলে সোনা আর শেয়ার বাজারের ‘ফাটকায়’ ব্যবহার হচ্ছে। এতে কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থায় কোনও হেলদোল হচ্ছে না। আমাদের কর নীতি যে এই পরিস্থিতি জেনেও অন্ধ তার কিন্তু বড় প্রমাণ, এই কঠিন সময়ে কর্মীসঙ্কোচনের সিদ্ধান্ত। সরকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। তাই লাভক্ষতির হিসাবের বদলে এই মুহূর্তে তার দায় চাহিদা চাগান দেওয়া। কিন্তু তা না করে কর্মীসংকোচনের রাস্তায় হেঁটে আরও চাহিদা সংকোচনের ব্যবস্থা করছে সরকার। অথচ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে ২০১৬ সালে সরকারি ক্ষেত্রে বেতন বাড়ানোর ফলেই বৃদ্ধির অধঃপতনের হার কমানো গিয়েছিল বাজারে চাহিদা বাড়ায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে যাঁদের হাতে নগদ কুক্ষিগত তাঁরাই তো বিনিয়োগ করেন। ঠিকই। কিন্তু তাঁরা বিনিয়োগ করেন লাভের মুখ দেখতে। আমরা ঠিক যে ভাবে বেশি আয়ের আশায় সঞ্চয়ের ক্ষেত্র হিসাবে খুঁজি বেশি সুদের আমানত, ঠিক সে ভাবেই বিনিয়োগকারী খোঁজেন বেশি লাভের ক্ষেত্র। কিন্তু উৎপাদন করলে তো তা বিক্রিও করতে হবে। আর তা তো কিনব আপনি বা আমি। আমাদের হাতেই যখন পয়সা নেই তখন কিনবটা কী? তাই যাঁদের হাতে নগদের জোগান আছে তাঁরা তা উৎপাদনে না ঢেলে ঢালছেন সোনায় বা শেয়ারে।

কেন্দ্র কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ। কেন্দ্রের বক্তব্য, এখন যদি বাজার থেকে ধার করে কোষাগার ভরা হয় খরচ করার জন্য, তা হলে আগামী দিনে বাজারে ঋণপত্র বেচে টাকা তুলতে অনেক সুদ দিতে হবে। হিসাবটা বোঝায় কোনও অসুবিধা নেই। আপনার যদি ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে টাকা থাকে তা গচ্ছিত রেখে সহজ শর্তে ঋণ পেতে পারেন। কিন্তু তা না থাকলে আপনাকে ঋণ পেতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হবে। সরকারের ক্ষেত্রেও তাই।

কেন্দ্রের বক্তব্য, রাজকোষ ঘাটতি বাড়ছেই। তার উপর ঋণের বোঝা বাড়লে তা সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। রঘুরাম রাজন কিন্তু তা মানতে নারাজ। লিঙ্কড্ইনে লেখা তাঁর ‘অ্যালার্ম ইন জিডিপি নাম্বারস’ শীর্ষক একটি লেখায় তাঁর যুক্তি যে— সরকার এটা করলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে দ্রুত। তাঁর যুক্তি, সরকার যদি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় তা হলে ঋণের বাজারে ভারতের সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকবে। আগামীতে বেশি সুদ দিয়ে টাকা তোলার দায়ও তৈরি হবে না।

আরও পড়ুন: হাজারেরও বেশি চিনা ছাত্রের ভিসা বাতিল করল আমেরিকা

কিন্তু সরকার তো সেই রাস্তায় হাঁটতে রাজি নয়। রঘুরাম রাজন, কৌশিক বসুর মতো অর্থনীতিবিদরা— যাঁরা এ দেশের অর্থনীতির একটা কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন— বলছেন মনরেগার মতো পরীক্ষিত প্রকল্পে এখনই টাকা ঢেলে সাধারণের হাতে নগদ জোগানের ব্যবস্থা করা উচিত। এবং তার জন্য যা ঋণ করা প্রয়োজন হবে তা করেই।

আরও পড়ুন: সংঘাতের আবহেই মস্কোয় ভারত-চিনের বৈঠক

আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে এই যুক্তি বোঝার অসুবিধা নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবই বলছে নগদ আর জিডিপির অনুপাত বাড়ছে। অর্থাৎ বাজারের পরিসরের তুলনায় টাকার জোগান বাড়ছে। আমরা দেখছি শেয়ার সূচক বাড়ছে। অর্থাৎ শেয়ার বাজারে টাকা খাটছে। তার মানে বাজারে যাঁদের হাতে এই নগদের জোগান কুক্ষিগত, তাঁরা পণ্যবাজারের চাহিদা বাড়ান না। তাঁরা লাভের অনুসারী। কিন্তু চাকুরিজীবী থেকে অন্য সাধারণ রোজগেরে মানুষের হাতে নগদ নেই। আর তাঁদের হাতে টাকা পৌঁছলেই বাজারে চাহিদা বাড়বে আর অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু সরকার এই যুক্তি না মেনে হাঁটছেন উল্টো রাস্তায়। চাপ কিন্তু আপনার আর আমার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement