রসলাল দাস এবং রঞ্জিৎ পাল (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র
এ যেন দুই হুজুরের গল্প।
এক জন শিলচর কালীবাড়ি চরের রসলাল দাস। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সব্জি বিক্রি করেন। সঙ্গে বয়ে বেড়ান দোতারাও!
না, দোতারা বিক্রি করেন না তিনি। বোঝা বইতে বইতে ক্লান্তি এলে ছায়া খুঁজে বসে গান ধরেন। দোতারায় সুর তোলেন। সময় হলে সব্জি বেচতে বেচতেই চলে যান সঙ্গীত শিক্ষকের বাড়ি। লোকগীতি শেখেন। দোতারার ব্যকরণ জেনে নেন। আকাশবাণীর ‘বি-গ্রেড’ শিল্পী। এ ভাবেই এক সুরে গাঁথা তাঁর গানবাজনা ও জীবিকা।
অন্য জন আঙ্গারজুরের রঞ্জিত দাস। তরুণ বয়সে দোকানে মনের মতো বাঁশি না পেয়ে নিজেই তা তৈরি শুরু করেন। এখন বাঁশি বিক্রিই পেশা। সাইকেলে হরেক রকম বাঁশি নিয়ে শহরের অলিগলিতে ঘোরেন। ক্রেতা টানতে সারাদিন বাঁশি বাজান। ক্লান্তি নেই। গানের আসরেও অংশ নেন। বাঁশি ছাড়াও তাঁর নামডাক সারিন্দা ও দোতারার জন্য। তিনটি বাদ্যযন্ত্রে তিনিও আকাশবাণীর ‘বি-গ্রেড’ শিল্পী। গানও পছন্দ তাঁর। আগে মালজোড়া গাইতেন। এখন মালজোড়ার আয়োজন কেউ করে না বলে লোকগীতি গান। কীর্তনও করেন।
এই দুই অখ্যাত শিল্পীকে এ বার বড় মঞ্চে নিয়ে এল শিলচরের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘ছন্দনীড়’। বাংলা সঙ্গীত জগতের পরিচিত ব্যক্তিত্ব চন্দ্রাবলী রুদ্র দত্ত ও দীপাবলি দত্তের সঙ্গে একই মঞ্চে উঠলেন রঞ্জিৎ, রসলাল। সংস্থার ত্রয়োদশ বার্ষিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন তাঁরা। দু’জনের কথা শুনে বিস্মিত চন্দ্রাবলীদেবীরা। তাঁরা বললেন, ‘‘কত প্রতিভা যে ছড়িয়ে রয়েছে! সুযোগ না পাওয়ায় তাঁদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে না।’’
‘‘সব্জির সঙ্গে দোতারা মেশানো বড় কঠিন কাজ। কিন্তু ওই দু’টোকে নিয়েই আমার জীবন’’— এ কথাই বললেন বছর ছত্রিশের রসলাল। বাবা-ঠাকুমা গান গাইতেন। কীর্তন করতেন। শুনে শুনে তিনিও গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। কোথাও ভুল হলে বাবা সুর ধরিয়ে দিতেন। পরে খোঁজ পান মনোরঞ্জন মালাকারের। তাঁর বাড়িতেও সব্জি বিক্রি করতে যেতেন। এক দিন সাহস করে তালিম নেওয়ার ইচ্ছের কথাটা বলেই দিলেন। এমন নিষ্ঠাবান শিষ্য পেলে কোন গুরুর না মন গলে! মনোরঞ্জনবাবুও এক কথায় রাজি হয়ে যান। এখনও তাঁর কাছে নিয়মিত তালিম নেন রসলাল।
বৃদ্ধ মা-বাবা, এক ছেলে, দুই মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে সাত জনের সংসার। নদীর তীরে ঝুপড়িতে ভাড়া থাকেন তিনি। রসলাল বললেন, ‘‘রেওয়াজের জায়গার বড় সমস্যা। তাই সব্জির টুকরিতে দোতারাটা থাকলে সুযোগ মত গলা ছাড়া যায়।’’
৫৮ বছরের রঞ্জিতের অবশ্য রেওয়াজের সমস্যা নেই। সারা দিন বাঁশি লেগে থাকে ঠোঁটেই। নেশাটা পুরোমাত্রার পেশা হল কী করে? রঞ্জিত জানান, সে অনেক পুরনো কাহিনি। এক দিন বাঁশি কিনতে গিয়েছিলেন দোকানে। এক-দু’টি বাঁশিই শুধু দেখান দোকানদার। সে দিনই জেদ চাপে। রাতে বাঁশ কিনে বাঁশি তৈরির চেষ্টা শুরু করেন। সাফল্যও মেলে। এর পর থেকেই সাইকেলে বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন আকারের বাঁশি। শিশু-কিশোরদের বাঁশি, সুরের বাঁশি—দুই। তাঁর বাঁশির সুরে রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে পড়েন। বাজাতে না-পারলেও অনেকে নিয়ে যান। কেউ কেউ আবার বাড়ি গিয়েও শিখতে চান। এখন তাই বাড়িতে বাঁশির ক্লাসও করান রঞ্জিৎবাবু।
‘ছন্দনীড়’-এর প্রশান্ত চক্রবর্তী ও পার্থ শীল জানান, রঞ্জিতের বাঁশি শুনে তাঁর দিকে নজর পড়ে। কিন্তু রসলালের প্রতি আকর্ষণটা অন্য জায়গায়। সম্পাদক ভাস্কর দাস এক দিন আচমকা দেখেন, সব্জির টুকরিতে দোতারা বয়ে চলেছেন এক যুবক। তিনি তাঁর পিছু নেন। দেখতে পান, দোতারা হাতে তুলে মনোরঞ্জন মালাকারের বাড়িতে ঢুকলেন রসলাল। বোঝার আর বাকি থাকে না ভাস্করের।
তাই তাঁকেই এ বার ত্রয়োদশ বার্ষিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধক করে সংবর্ধনা জানানো হয়। সঙ্গে রঞ্জিতের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় হলভর্তি দর্শক-শ্রোতার— তিনি শুধু বাঁশি-বিক্রেতাই নন, শিল্পীও।
ভাস্কর বললেন, ‘‘আমরা এমন শিল্পীদেরই সারা বছর খোঁজ করি। দ্বাদশ বার্ষিক অনুষ্ঠানের যেমন উদ্বোধন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দেবনাথ, শ্রীহরি দাসের মত অন্ধ শিল্পীরা।’’ স্ত্রীকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন এ বারও হাজির ছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বসে থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।