শাহিন বাগে প্রতিবাদীদের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী সঞ্জয় হেগড়ে ও সাধনা রামচন্দ্রন। ছবি: পিটিআই
টানা ৬৭ দিন রাস্তায় বসে থাকার পরে এই প্রথম কথা শুনতে আর বলতে এসেছেন কেউ।
আজ দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো দুই মধ্যস্থতাকারীকে সামনে পেয়ে নিজেদের ক্ষোভ, যন্ত্রণা, উদ্বেগ এমনকি কান্নাও উজাড় করে দিল শাহিন বাগ। প্রশ্ন ছুড়ল, ‘‘শুধু রাস্তা রোখাটুকুই দেখলেন? কত কোণঠাসা হলে, মহিলাদের এ ভাবে দিনের পর দিন পথে বসে থাকতে হয়, এক বারও ভেবেছেন?’’
সন্ধে নামার মুখে দুই আইনজীবী প্রতিনিধি— সঞ্জয় হেগড়ে ও সাধনা রামচন্দ্রনের তরফে প্রতিশ্রুতি এল, প্রতিবাদীদের অধিকার এবং স্বাধীনতা বজায় রাখতে এই এককাট্টা লড়াইয়ের বার্তা সর্বোচ্চ আদালতের দরজায় পৌঁছে দেবেন তাঁরা। তার আগে, সমস্যার শিকড় আরও ভাল করে খুঁজতে কাল, বৃহস্পতিবার ফের আন্দোলনকারীদের মঞ্চে আসবেন তাঁরা। প্রতিবাদীরা চাইলে রবিবার পর্যন্ত কথা হবে রোজ।
মোদী সরকারের প্রতি শাহিন বাগের বিশ্বাস কোন তলানিতে ঠেকেছে, আজ তা টের পাওয়া গেল প্রতি পদে। যার জেরে তাল কাটতে বসেছিল আলোচনার শুরুতেই। সাধনা বললেন, এমন সারি সারি ক্যামেরার সামনে কথা বলা সম্ভব নয়। প্রতিবাদের প্যান্ডেল আর তার বাইরে থেকে সমস্বরে উত্তর এল, ‘‘তা চলবে না। কথা বলতে হবে সংবাদমাধ্যমের সামনেই।’’ মুহূর্তে তৈরি হয়ে গেল অবিশ্বাসের আবহ। পাশে দাঁড়ানো রফিকুল্লাই বললেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম আমাদের অনেক বদনাম করেছে। তবু কথা ক্যামেরার সামনেই হোক। নইলে পরে সরকার কী বলে, কে জানে!’’
মধ্যস্থতাকারীরা বললেন, ‘‘এই শর্ত মানতে হলে, শুধু শুনব। নিজেরা কিছু বলব না।’’ সংবাদমাধ্যম মঞ্চের পাশ থেকে সরে এল ঠিকই। কিন্তু এর পরে দু’পক্ষের মধ্যে কথা হল আগাগোড়া মাইক্রোফোন হাতে ধরে। যাতে চত্বরের সবাই সবটুকু শুনতে পান!
শাহিন বাগের আরও প্রশ্ন
• সিএএ-এনআরসি ফিরিয়ে নিলে, আধ ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা খালি করব। কিন্তু সরকার সংসদে সেই কথা দিতে পারবে কি?
• দু’মাসেরও বেশি রাস্তায় রয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীর আসার সময় হল না?
• প্রধানমন্ত্রী ‘সব কা সাথ’-এর স্লোগান তোলেন, তাঁর মন্ত্রীই ‘গোলি মারো শালো কো’ বলেন কী করে?
• স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী ভাবে বলেন শাহিন বাগকে শক দেওয়ার কথা! আমরা এ দেশের নাগরিক নই?
• মুসলিম বেছে আক্রমণ কেন? আমাদের নিরাপত্তার দায় সরকারের নয়? নাকি জামিয়ায় পুলিশি লাঠি, গুলিই আমাদের জন্য বরাদ্দ?
• শুধু রাস্তা আটকে থাকাই একমাত্র সমস্যা? আমরা এ দেশে থাকতে পারব কি না— সেই ভয়ের দাম নেই?
• প্রধানমন্ত্রী সিএএ নিয়ে পিছু হটবেন না। আমাদের সরতে বলা হচ্ছে কেন?
• কখনও দেশদ্রোহী বলা হয়, কখনও বলা হয় টাকা আর বিরিয়ানির লোভে বসে আছি। আমাদের সম্মানে আঘাত করতে বাধল না?
• ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কেন ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন? পাকিস্তানের এই চেহারা পছন্দ নয় বলেই ভারতকে নিজেদের দেশ মেনেছি! তা হলে নাগরিকত্ব প্রমাণে কাগজ চাওয়া হবে কোন সাহসে?
• ভোটার কার্ড যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ না-হয়, তার ভিত্তিতে ভোটে সরকার নির্বাচিত হয় কী ভাবে?
• আজ রাস্তা থেকে উঠে গেলে আগামী প্রজন্ম জিজ্ঞেস করবে, আমাদের অধিকার লুট হওয়ার সময়ে রুখে দাঁড়াওনি কেন?
শাহিন বাগের আইনি-সওয়াল
• জাতীয় সড়কের ১৫০ মিটার না হয় আন্দোলনের জন্য বন্ধ। কিন্তু পুলিশ সমান্তরাল এবং বিকল্প রাস্তা বন্ধ রেখেছে কেন?
• রাস্তা বন্ধ থাকায় অসুবিধার প্রমাণ কোথায়?
• টানা বন্ধ অমিত শাহের বাড়ির সামনের রাস্তাও। অসুবিধা শুধু এখানকার জন্যই কেন?
• কে বলল অ্যাম্বুল্যান্স, স্কুল বাস আটকানো হচ্ছে? আজকেও তো তা পার হল!
• সারা দেশে যত প্রতিবাদী, যন্তর-মন্তর বা রামলীলা ময়দানে তাঁদের সবার জায়গা হবে?
প্রথম থেকেই প্রতিবাদীদের অভিযোগ, সমস্যা শুনতে প্রতিনিধি পাঠানো তো দূর, বরং শাহিন বাগকে নিশানা করেছে সরকার। তাই সুপ্রিম কোর্ট যে অন্তত কথা বলতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে, তাকে স্বাগত জানালেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু রাস্তা ছেড়ে আন্দোলন কিংবা অন্যদের অসুবিধাও ভাবার কথা মধ্যস্থতাকারীদের মুখ থেকে বেরোলেই, পত্রপাঠ তা খারিজ করে দিয়েছে জনতা। সঙ্গে সঙ্গে দানা বাঁধছে সন্দেহ, ‘‘শুধু ওই রাস্তা খোলার জন্যই এঁদের আসা!’’
এই রাগের জন্য সম্ভবত তৈরি ছিলেন মধ্যস্থতাকারীরাও। যে কারণে আগে প্রতিবাদীদের বিশ্বাস অর্জনে মন দিলেন তাঁরা। বললেন, ‘‘কোনও তাড়া নেই। সকলের কথা শুনব। সবার আগে দাদিদের।’’
ক্ষোভের ঝাঁপি খুলে যাওয়ার পরে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন টানা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া মহিলারা। কারও গলায় ক্ষোভ, কেউ তেমনই কেঁদে ফেললেন কথা বলার সময়ে। হেগড়ে আল্লার নামে শপথ করে ফের আসার প্রতিশ্রুতি যখন দিলেন, তখন হাততালিতে কান পাতা দায়। একই প্রতিক্রিয়া তিনি ‘আজাদির পয়গম’ (স্বাধীনতার বার্তা) সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তুলে ধরার কথা দেওয়ায়। তেমনই সাধনার মুখ থেকে অবস্থানস্থল সম্পর্কে ‘মেহফিল’ শব্দ খসতেই, মুহূর্তে বদলে গেল পরিবেশ। আন্দোলনকারী মহিলা কেটে কেটে বললেন, ‘‘আমরা শখ করে এখানে বসে নেই। বরং রোজ আলোচনা করি, কবে এই প্রতিবাদ শেষ হবে। ফিরতে পারব স্বাভাবিক জীবনে। আমাদেরও সংসার আছে। সন্তান আছে।’’ ভেসে এল কটাক্ষও, ‘‘অনেকে মনে করেন আমাদের প্রতিবাদ বিরিয়ানির জন্য। শুধু তার জন্য হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কেউ দিনের পর দিন বসতে পারবেন তো?’’ বোঝাতে হল, মধ্যস্থতাকারী ও ভাবে ‘মেহফিল’ বলেননি।
কাঁপা গলায় দাদি, পরিষ্কার উচ্চারণে তরুণী কিংবা দেহাতি ভাষায় মধ্যবয়সিদের বার্তা একই, ‘‘সিএএ-এনআরসি বাতিল না-হওয়া পর্যন্ত রাস্তা খোলার প্রশ্ন নেই। সম্ভাবনা নেই আন্দোলনকে অন্য কোথাও সরানোর। তাতে যা হওয়ার হোক।’’ তা ছাড়া, ওই সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্ম এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তে দানা বাঁধা প্রতিবাদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা হবে বলে তাঁদের দাবি।
প্রতিবাদীদের বক্তব্য শুনে হেগড়ে বললেন, ‘‘এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারবেন না আমাদের সন্তানরাও। যাঁরা অনেক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়া।’’ উপস্থিত অনেকে বললেন, ‘‘কামাল করে দিয়েছেন প্রতিবাদীরা।’’ যদিও বিজেপির অভিযোগ, অনেক দিন ধরে মহড়া হয়েছে। এর পিছনে মাথা রয়েছে অনেকের। যাঁর মধ্যে আছেন গুজরাতের অন্যতম মোদী-বিরোধী মুখ, সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাড়ও।
দুই মধ্যস্থতাকারী মঞ্চ ছাড়ার পরেই হাজির ওয়াজাহাত হাবিবুল্লা। শুরুতে শোনা গিয়েছিল, তাঁকেও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বললেন, ‘‘শাহিন বাগের কথাও যাতে শোনা হয়, তা নিশ্চিত করতে মামলা দায়ের করায় আমার দায়িত্ব, আন্দোলনকারীরা যাতে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন, সেই বিষয়টি বোঝানো।’’
রাস্তা বন্ধ থাকা নিয়ে অভিযোগের বিরুদ্ধে কী কী আইনি যুক্তি তোলা হবে, হাবিবুল্লা ও তাঁর পিছনে দাঁড়ানো আইনজীবী বলতেই প্রবল হাততালি। তা শেষ হতেই এক দাদির প্রশ্ন, ‘‘আপনি তা হলে ওই দু’জনের সঙ্গে এলেন না কেন? এখানেও দুই দল?’’
অবিশ্বাসের ক্ষত দগদগে!