ছবি কার, বেঁধে দিল সুপ্রিম কোর্ট

সরকারি বিজ্ঞাপনে এখন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ আর দেখা যাবে না। কারণ, শীর্ষ আদালতের সে রকমই নির্দেশ। আদালতের বক্তব্য, রাজনীতির মুখ যাতে সরকারি বিজ্ঞাপনকে ঢেকে না-দেয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, সরকারি বিজ্ঞাপনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা ভারতের প্রধান বিচারপতি ছাড়া আর কারও ছবিই ব্যবহার করা যাবে না। বাদ পড়বেন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। ফলত যা দাঁড়াল, তাতে পশ্চিমবঙ্গে মমতার ছবিওয়ালা সরকারি বিজ্ঞাপনগুলিও বাতিল করতে হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

সরকারি বিজ্ঞাপনে এখন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ আর দেখা যাবে না। কারণ, শীর্ষ আদালতের সে রকমই নির্দেশ। আদালতের বক্তব্য, রাজনীতির মুখ যাতে সরকারি বিজ্ঞাপনকে ঢেকে না-দেয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।

Advertisement

বুধবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, সরকারি বিজ্ঞাপনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা ভারতের প্রধান বিচারপতি ছাড়া আর কারও ছবিই ব্যবহার করা যাবে না। বাদ পড়বেন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। ফলত যা দাঁড়াল, তাতে পশ্চিমবঙ্গে মমতার ছবিওয়ালা সরকারি বিজ্ঞাপনগুলিও বাতিল করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মহাত্মা গাঁধীর মতো প্রয়াত নেতার ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কিন্তু জীবিত নেতানেত্রীদের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রপতি, ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবিই তাঁদের অনুমতি সাপেক্ষে সরকারি বি়জ্ঞাপনে ব্যবহার করা যাবে। সুতরাং শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নয়, এখন থেকে কোনও সরকারি বিজ্ঞাপনে কোনও মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছবি থাকবে না। তা সে বিজ্ঞাপন কেন্দ্রীয় সরকারেরই হোক বা
রাজ্য সরকারের।

Advertisement

যদিও সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, তা নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলের তরফে যেমন দাবি করা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ও রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য। রাজ্য সরকারের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন, এটার নিশ্চয়ই কোনও ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া বিজ্ঞাপনের কথাই বলতে চেয়েছে। কিন্তু মামলার অন্যতম আইনজীবী মীরা ভাটিয়ার যুক্তি, ‘‘কেন্দ্র, রাজ্য বা যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য।’’

ঘটনা হল— কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, তৃণমূল হোক বা বিজেপি বা অন্য দল, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ কিন্তু কাউকেই খুশি করেনি। সরাসরি আদালত-বিরোধিতায় না গিয়েও নানা ভাবে সেই অসন্তোষ এ দিন প্রকাশও পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে এই নির্দেশের বিরুদ্ধেই সওয়াল করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি বলেন, ‘‘এ সব বিষয় আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে। সরকার নিজের নীতি ও প্রকল্প বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই মানুষকে জানায়। এতে আদালতের নাক গলানো ঠিক নয়।’’ সরকারি বি়জ্ঞাপনে কী থাকবে না থাকবে, তা নিয়ে মত দিয়ে আদালত কার্যত ‘আগাম সেন্সর’-এর কাজ করছে বলেও সতর্ক করেছিলেন রোহতগি।

সূত্র বলছে, আদালতের এই নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকারকেও কিছুটা সমস্যায় ফেলল। কারণ সামনেই মোদী সরকারের বছর-পূর্তি। বিভিন্ন মন্ত্রকের তরফে বিজ্ঞাপন তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই সব বিজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ছবি আর ব্যবহার করা যাবে না। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রীদের ছবি ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে গেলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোও একই রকম সমস্যায় পড়বে। বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী মায়াবতী সরাসরিই বলেছেন, ‘‘এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা হলে রাজ্য সরকারের অসুবিধা হবে।’’ কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের প্রশ্ন, ‘‘এত তুচ্ছ বিষয়ে শীর্ষ আদালত মাথা ঘামাচ্ছে কেন?’’

সু্প্রিম কোর্ট অবশ্য বিষয়টি ‘তুচ্ছ’ বলে মনে করছে না। গত বছরই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবম, বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও বিচারপতি এন ভি রমান্নার বেঞ্চ বলেছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনসাধারণের টাকা অপচয় করে যথেচ্ছ সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে চায় আদালত। এ বিষয়ে অন্যান্য দেশে কী ধরনের নিয়ম রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে আইন-বিশেষজ্ঞ মাধব মেননের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটিও তৈরি করা হয়। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি সদাশিবম অবসর নিয়েছেন। আজ আদালতের পর্যবেক্ষণ, নিজেদের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন করে রাজনৈতিক নেতারা সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে নিজেদের এক করে দেখাতে চাইছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ‘ব্যক্তিপুজো’র পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

মামলাটির শুরু ২০০৩ সালে। একটি বেসরকারি সংগঠনের তরফে করা জনস্বার্থ মামলায় বাজপেয়ী সরকারের ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ও তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার ছবি দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, জনগণের টাকা খরচ করে সরকারি প্রচার কার স্বার্থে। সুপ্রিম কোর্ট তখন সমস্ত রাজ্য সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়ে নোটিস জারি করে। কেন্দ্র ও রাজ্যের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে নিজের বক্তব্য জানান। সেই সঙ্গে আদালতের তৈরি কমিটির সুপারিশও জমা পড়ে। সেই কমিটি অবশ্য বলেছিল, সরকারি বিজ্ঞাপনে ব্যক্তির ছবি রাখাই বন্ধ করা হোক। নির্বাচনের আগে সরকারি বিজ্ঞাপনে রাশ টানা হোক। এমনকী, বিজ্ঞাপনে সরকারি কাজকর্মের যে খতিয়ান দেওয়া হয়, তার পারফরম্যান্স অডিট করানোর সুপারিশও ছিল। বিচারপতিরা অবশ্য শেষ অবধি তাঁদের নির্দেশিকায় এতটা কড়া অবস্থান নেননি।

আজকের পরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনদাতা সংস্থা বা তথ্য-সম্প্রচার দফতরকে আদালতের বলে দেওয়া রূপরেখা মেনে চলতে হবে। তার নজরদারির জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি তৈরির কথাও বলেছে কোর্ট। তবে সেই কমিটিতে কারা থাকবেন, তা ঠিক করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারেরই। আবেদনকারী আইনজীবী ও সামাজিক আন্দোলনকারী প্রশান্ত ভূষণ বলেন‘‘শুধু নতুন বিজ্ঞাপন নয়। যে সব রাজ্য সরকার মুখ্যমন্ত্রী ও দলের নেতাদের ছবি দিয়ে পুরনো বিজ্ঞাপন-হোর্ডিং টাঙিয়ে রেখেছে, সে সবও এ বার নামিয়ে ফেলতে হবে।’’

এক দিকে রাজনৈতিক শিবির, অন্য দিকে সমাজকর্মী— আজকের নির্দেশিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে দু’দলেরই। সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, আজকের নির্দেশিকা ত্রুটিমুক্ত নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণও নয়। যদি এর মধ্যে কোনও ছিদ্র থাকে, তাবে প্রশাসন তা মেরামত করে নিতে পারে। রাজনীতিকদের একটা বড় অংশের মতে, শাসক দলের নেতানেত্রীদের মুখ যদি সরকারি বিজ্ঞাপনে অনভিপ্রেতই হয়, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থাকবে কেন? তিনিও এক জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংবিধানিক পদাধিকারী নন। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ফায়দা বা ব্যক্তিপুজোর সুযোগ পুরোমাত্রায় থাকছে। আবার, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যদি প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছাড় পায়, তা হলে একই সুবিধা রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী পাবেন না কেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। জেডিইউ সাংসদ পবন বর্মা-সহ বহু আঞ্চলিক দলের নেতাই এ প্রশ্ন তুলছেন। সরকারি কাজকর্মে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতির ছবি কেন ছাপা হবে, তা নিয়েও কথা উঠছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘যাঁরা সরকার চালান, তাঁদের ছবি থাকবে না। আর যাঁরা সরকার চালান না, তাঁদের ছবি থাকবে? এটা আদালত ভেবে দেখুক।’’ রাজ্যে সরকারি বিজ্ঞাপন যে ভাবে ইদানীং মুখ্যমন্ত্রীর ছবিতে ছয়লাপ হয়ে থাকে, তা নিয়ে আগে একাধিক বার কটাক্ষ করেছেন বিরোধী বামেরা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ছবিতে সায় দিয়েছে, সেটা তাঁদেরও খুশি করেনি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, ‘‘সরকারি বিজ্ঞাপনে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ছবি রাখতে বলার যুক্তিও বোঝা যাচ্ছে না। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতি আসবেনই বা কী ভাবে? এর চেয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনে ব্যক্তির ছবি ব্যবহারেই নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বেশি যুক্তিযুক্ত হতো বলে মনে হয়।’’

সমাজকর্মীদের একাংশ মনে করছেন, ঢালাও সরকারি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণের টাকা অপচয় হওয়ার সমাধানসূত্র কিন্তু আজকের নির্দেশিকায় পাওয়া যায়নি। কারণ সরকারি বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচারের ক্ষেত্রে আলাদা করে রাশ টানা হয়নি। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানার পাঁচ বছরে প্রয়াত নেতানেত্রীদের স্মরণে বিজ্ঞাপন দিয়ে ১৪৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। মোদী সরকার শুধু স্বচ্ছ ভারত অভিযানের বিজ্ঞাপনেই ৪০ কোটির বেশি টাকা খরচ করেছে। আদালতের নির্দেশিকায় কিন্তু এর কোনওটাতেই কাটছাঁটের জায়গা নেই। প্রশান্ত ভূষণ অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের নিজের বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলছেন, এখানেই শেষ নয়। আদালতের কাছে তাঁরা আবারও নিজেদের আর্জি জানাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement