প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিন ভারত সফররত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশে ফিরে যান। সালটা ছিল ২০১৫। সে দিনই রাতে সেই সময়কার বিদেশসচিব সুজাতা সিংহকে ডেকে পাঠিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। জানিয়েছিলেন, তাঁকে সময়ের আগেই সরে যেতে হবে। নতুন বিদেশসচিব হবেন এস জয়শঙ্কর।
ইতিহাসের কালচক্রে এ বার সেই সুষমা স্বরাজকে সরিয়ে বিদেশমন্ত্রীর পদে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববদ্যালয়ের পিএইচডি তথা ১৯৭৭ সালের আইএফএস ক্যাডার জয়শঙ্কর। আজ পদ পাওয়ার পরই বিকেলে সাউথ ব্লকে গিয়ে কার্যভার গ্রহণ করেছেন তিনি।
এই প্রথম কোনও বিদেশসচিব বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্বে। স্বাভাবিক ভাবেই নড়েচড়ে বসছে গোটা বিদেশমন্ত্রক। কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, গত পাঁচ বছর সুষমা মন্ত্রী ছিলেন ঠিকই কিন্তু বিদেশনীতি আগাগোড়া নিজ হাতে পরিচালনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আগামী পাঁচ বছরে যে তিনি তা করবেন না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তবে জয়শঙ্কর চিন, আমেরিকা এবং রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলিকে পেশাদারের চোখে কাছ থেকে দেখেছেন দীর্ঘদিন। প্রশ্ন হল, এই কূটনীতিককে রাজনৈতিক ভাবে কতটা কাজে লাগাতে পারবে মোদী সরকার।
মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই জয়শঙ্কর তাঁর নেকনজরে আসেন। সে সময় চিনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জয়শঙ্কর, বেজিং সফররত মোদীকে সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন নিজ উদ্যোগে। যা গুজরাতে চিনের বিনিয়োগ সুনিশ্চিত করতে সে সময়ে সহায়তা করেছিল। এই ঘটনাটি যে মোদী ভোলেননি, তা বোঝা যায় তিনি ২০১৪ সালে ক্ষমতায়
আসার পর সুজাতার মেয়াদ ছেঁটে জয়শঙ্করকে বিদেশসচিব করায়। গত কালের সিদ্ধান্ত ওই পুরনো ভরসারই পরবর্তী ধাপ।
মন্ত্রী হিসেবে প্রথম বছরটিতেই জয়শঙ্করের সামনে রয়েছে ঠাসা কর্মসূচি। কূটনৈতিক জগতে বিবদমান রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার জন্য প্রসিদ্ধ জয়শঙ্করের সামনে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিরঘিজস্তানে এসসিও সম্মেলন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এমন ভাবে সরু দড়ির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে যাতে সাপও মরে, অথচ লাঠিও না ভাঙে। এক দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার রাস্তা বার করে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ফেরানোর মসিহা হিসেবে নিজেকে দেখাতে চাইছেন মোদী। পাশাপাশি তাঁকে এই কাজে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে, কারণ দেশটার নাম পাকিস্তান। এর আগে ইসলামাবাদের সঙ্গে সৌজন্য এবং উষ্ণতা দেখিয়ে হাত পোড়ানোর অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জয়শঙ্কর তাঁকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান, সেটা দেখার।
আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কেও যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে ভারত। রাশিয়া থেকে অস্ত্র এবং ইরান থেকে তেল আমদানির প্রশ্নে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তথা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এক সময় আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছেন বলেই শুধু নয়, আমেরিকার বিভিন্ন কর্তার সঙ্গে জয়শঙ্করের ব্যক্তিগত সখ্য খুবই উষ্ণ। নিঃসন্দেহে এ কাজে তাঁর উপর সর্বতো ভাবে নির্ভর করবেন মোদী।
চিন একটি বড় অস্বস্তির ক্ষেত্র। যাদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে ভারত বিশেষ লাভবান হয়নি মোদীর প্রথম ইনিংসে। ২০১৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি যা ছিল, তা ২০১৯ এসে তা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। চিনা মহাযোগাযোগ প্রকল্প ওবর-এ যোগ দেওয়ার জন্য চাপও বাড়াচ্ছে বেজিং। ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলপথে চিনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্যও ভারতের প্রবল অস্বস্তির কারণ। এই অবস্থায় এলাকার রাষ্ট্রগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চিনের সমান্তরাল একটি অক্ষ তৈরি করা এবং একই সঙ্গে চিনের সঙ্গে সংঘাতে না-গিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্কে উন্নতি ঘটানো— এই অতি কঠিন কাজটি সামনে রয়েছে জয়শঙ্করের।