১৪৯৮ সালে ভারতের দক্ষিণের মালাবার উপকূলের কালিকটে পৌঁছেছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামা। তিনিই প্রথম ইউরোপ থেকে জলপথে ভারতে আসার রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন। তারও কয়েক বছর পরে ১৫০৩ সালে ভারতের কোচিতে প্রথম দুর্গ স্থাপন করেন পর্তুগিজরা।
শুরু হয় ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইউরোপ এবং ভারতের মধ্যে ব্যবসার খাতিরে যাতায়াত শুরু হয় পর্তুগিজদের। পর্তুগিজদের দখলে প্রায় চলেই গিয়েছিল গোয়া, সে সময়ই তাঁদের আগ্রাসন থেকে গোয়াকে রক্ষা করেছিলেন এক রানি। ভারতের ইতিহাসে ঝাঁসির রানি, গায়েত্রী দেবী, রাজিয়া সুলতানাদের নাম আমরা পড়েছি। কিন্তু খুব মানুষই এই রানির কথা জানেন।
১৫৫২ সালে ভারতের দক্ষিণে মাথা তুলে দাঁড়ায় সালুভা সাম্রাজ্য। অনেকেই জানেন না, প্রায় ৫৪ বছর ধরে এই সাম্রাজ্যের রাশ শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন এক রানি। ভারতের ইতিহাসে এত বছর ধরে সাম্রাজ্য শাসন করা তিনিই একমাত্র মহিলা।
রানি চেন্নাভইরাদেবী। গোয়া থেকে, উত্তর কন্নড়, দক্ষিণ কন্নড়, মালাবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। সালুভা সাম্রাজ্য। যার রাজধানী ছিল গেরুসোপ্পা।
তাঁর রাজত্বকাল ছিল প্রজাদের কাছে সুখের সময়। তাঁর উদারতার ছোঁয়া সকল প্রজাদের কাছেই পৌঁছত সমান ভাবে। পাশাপাশি তাঁর রাজত্বকালে সালুভায় ব্যবসার প্রসারও ঘটেছিল অনেক।
সে সময় পর্তুগিজদের অনেকেই ওই অঞ্চলের ব্যবসা করতে এবং বন্দরগুলোর দখল করতে চেয়েছিল। পর্তুগিজদের সেই আগ্রাসনকে তিনি প্রতিহত করেছিলেন একাই। বহুদিন ধরে প্রতিহত করে রেখেছিলেন পার্শ্ববর্তী কেলাড়ি এবং বিলগি রাজাদের আগ্রাসনকেও।
তাঁর নামাঙ্কিত তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল সে সময়। তাঁর রাজত্বকালে সালুভা সাম্রাজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ব্যবসা এবং পর্যটনের সূত্রে এখানে আসতেন।
তাঁর সাম্রাজ্যের হন্নাবর, ভাতকালা অঞ্চলগুলো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাজারে পরিণত হয়েছিল। ইউরোপ থেকে ব্যবসার উদ্দেশে এই অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্য শুরু হয়।
রানি চেন্নাভইরাদেবী রাজত্বকালে এই অঞ্চলগুলোতে কালো মরিচ, সুপারি, জায়ফল এই মশলাগুলোর ব্যবসা প্রসার লাভ করে। সে কারণেই পর্তুগিজরা তাঁকে পেপার কুইন বা ‘মশলা রানি’ও বলতেন।
তিনি জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ১৫৬২ সালে তিনি কারকালায় শিখ মন্দির চতুর্মুখ বসারি নির্মাণ করেন। এ ছাড়াও তিনি বহু মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন।
৬৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে কর্নাটকের উত্তর কন্নড় জেলায় তিনি মিরজান দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সেই দুর্গ আজও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র। এই দুর্গে তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েও ছিলেন।
তাঁর পার্শ্ববর্তী কেলাড়ি এবং বিলগি রাজারা বহুদিন থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই গেরুসোপ্পার দখল নেওয়ার। অবশেষে দুই রাজা মিলিত ভাবে ১৬০৬ সালে রানি চেন্নাভইরাদেবীকে পরাজিত করেন।
ফলে গেরুসোপ্পা কেলাড়ি রাজত্বের অংশ হয়ে ওঠে। রানিকে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দি অবস্থাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাজত্বকালে বহু উদ্বাস্তুকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের এলাকায়। আজও ওই এলাকায় রানি চেন্নাভইরাদেবী উদারতার প্রতীক হিসাবে পরিচিত হন।