গোটা শহরটাই যেন একটা নিঝুমপুরী! শুধু শহরই বা কেন, রোহতক জেল থেকে ৪০ কিলোমিটারের একটা কাল্পনিক ব্যাসার্ধওয়ালা এলাকাই যেন দুর্ভেদ্য দুর্গের চেহারা নিয়েছে। ঘণ্টা চারেকের ব্যবধানে সেই দুর্গের ভিতর যাতায়াত আরও নিশ্চিদ্র হয়েছে। বেলা ১২টা নাগাদ যখন রোহতক জেলের উদ্দেশে এই পথ দিয়েই গিয়েছিলাম, তখনকার সঙ্গে এই বিকেল সাড়ে চারটের যেন বিস্তর ফারাক। ওষুধের দোকান ছাড়া আর প্রায় কিছুই খোলা নেই। বাসিন্দাদের রাস্তায় বেরনো পর্যন্ত বারণ করে দেওয়া হয়েছে!
আরও পড়ুন- রাম রহিমের সাজা ঘোষণার অন্তিম শুনানি চলছে
রোহতক জেলে পৌঁছনোর সময় দেখেছিলাম, চার দিকে সবুজ লকলকে আখের খেত। মাঝখান দিয়ে চিরে গিয়েছে পিচের রাস্তা। সেটাই একটু চড়াই হয়ে উঠে ছুঁয়েছে রোহতক জেলের সদর দরজা। সেখানেই দু’টি ধর্ষণের মামলার প্রতিটিতে রাম রহিমের ১০ বছর করে সাজা ঘোষণা করেছে সিবিআই-এর বিশেষ আদালত। আমরা সাংবাদিকেরা দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ঠিক ৮০০ মিটার দূরে। আখের খেত আর ওবি ভ্যানগুলোকে বাদ দিলে গোটা চরাচর যেন ধুধু করছিল!
হরিয়ানার বর্ধিষ্ণু শহরগুলির মধ্যে রোহতক অন্যতম। কিন্তু, গত তিন দিন ধরে কার্ফু চলছে। অফিস-কাছারি-স্কুল-কলেজ— সব বন্ধ। জনজীবন স্তব্ধ। সোমবার বেলা ১২টা নাগাদ যখন এই শহরে ঢুকেছিলাম, বেশ অবাকই লেগেছিল। এত কড়া নিরাপত্তা আগে কোথাও দেখেছি কি! ৮০০ মিটার দূরটাকে যদি ‘গ্রাউন্ড জিরো’ ধরি (কারণ তার ও পাশে যাওয়ার কোনও অনুমতি নেই), তা হলে আগে আরও ছ’টি চেকপোস্ট পেরিয়ে এসেছি। সব জায়গাতেই কড়া চোখে চেকিং হয়েছে। খুলে দেখা হয়েছে গাড়ির প্রায় প্রতিটি জায়গা। তবে জেল থেকে দু’কিলোমিটার আগে যে চেকপোস্ট, সেখান থেকে সাংবাদিক পরিচয় ছাড়া এগনোর কোনও ছাড়পত্র মেলেনি। আর জেলের ৮০০ মিটার আগে এসে সেই সাংবাদিকদেরও আটকে দেওয়া হয়।
এমনিতে রোহতক জেল খুবই সাদামাটা। সদর জেলগুলো যেমন হয়। কিন্তু, আজকের জন্য ‘হাইপ্রোফাইল’ ছিল সে। বাইরে থেকে জেলটাকে দেখা যাচ্ছিল বটে, কিন্তু ভিতরে কী চলছিল তা বোঝার কোনও উপায় ওই দূর থেকে অন্তত ছিল না। বেলা সওয়া দু’টো নাগাদ চপারে চেপে সিবিআই-এর বিচারক জগদীশ সিংহ জেলের ভিতরে বিশেষ ভাবে বানানো হেলিপ্যাডে নামেন। আমাদের উপর দিয়েই উড়ে গিয়েছিলেন। টিভি-র বন্ধুরা সেই ছবিই লাইভ পাঠিয়ে দিলেন গোটা দেশের কাছে, ওবি ভ্যানের মহিমায়। কিন্তু, বাকিদের জন্য সেই ছবি পাঠানো একেবারেই অসম্ভব। কারণ, গত তিন দিন ধরে রোহতকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। এমনকী, এসএমএস পরিষেবাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন- রাম-রহিমের মতো জেলে সাজা ঘোষণা আর যাদের যাদের
জেল চত্বরে হেলিকপ্টার নামা থেকে মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সাজা ঘোষণা করে দেওয়া হয়। জেলের রেস্ট রুমকেই এ দিন তাড়াহুড়ো করে আদালতের চেহারা দেওয়া হয়েছিল। সেই আদালতেই সিবিআই এবং রাম রহিমের আইনজীবীরা এক এক করে প্রায় ১০ মিনিট ধরে সওয়াল করেন। তার পর ১৫ মিনিটের বিরতি। এর পরেই বিচারক জগদীশ সিংহ সাজার রায় ঘোষণা করেন। আদালত সূত্রে খবর, সাজা ঘোষণার আগে বেশ কান্নাকাটি করেন রাম রহিম। বলেন, ‘মুঝে মাফ কর দো।’ সাজা ঘোষণার পর তাঁকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়ার সময়েও কাঁদতে দেখা গিয়েছে।
নিজের পরিণতির কথা ভেবেই হয়তো আদালতে, সর্বসমক্ষে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি রাম রহিম। তাঁর কি এক বারও মনে পড়েছিল, ‘বাবা’ হয়ে কত ‘মেয়ে’র চোখের জলের কারণ হয়েছেন তিনি?