জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সম্মেলনে মনমোহন সিংহ। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযোগ করে থাকেন, খয়রাতির রাজনীতি ও সিদ্ধান্তহীনতার চোরাবালিতে সংস্কারের রথ থমকে গিয়েছিল পূর্বসুরির জমানায়। ১৭ মাস পরে সেই পূর্বসূরি মনমোহন সিংহই আজ তাঁকে সতর্ক করে দিলেন, দেশ জুড়ে তৈরি করা অসহিষ্ণুতার পাঁকে উল্টো দৌড় শুরু হতে পারে অর্থনীতির। লগ্নি আসা তো দূর, সংঘাতের পরিবেশে পুঁজি পালিয়ে যেতে পারে দেশ থেকে।
হুঁশিয়ারিটা এল এমন সময়ে, যার অল্প কিছু ক্ষণ আগেই সংস্কার নিয়ে পুরো উল্টো সুর শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে। সংস্কারের রথ ছোটাবেন, বিদেশি বিনিয়োগ এনে দেশে শিল্প-বাণিজ্যের হাল ফেরাবেন— এমন আশা জাগিয়েই শুরুটা করেছিলেন তিনি। ১৭ মাস পরে এখন কার্যত ঢোঁক গিলছেন। দিল্লি ইকনমিক্স কনক্লেভে মোদী আজ জানিয়ে দিয়েছেন, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানোর চেয়েও জনগণেশকে সুরাহা দেওয়া তাঁর কাছে ঢের বেশি জরুরি। এবং সেই লক্ষ্যে সরকার কী কী করেছে তার খতিয়ানও তুলে ধরেন।
আর্থিক সংস্কারের তবে কী হবে?
মোদীর এ দিনের বক্তৃতায় তার দিশা মেলেনি। তবে তার শর্তগুলি আজ মোদীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের পূর্বশর্তই হল শান্তির পরিবেশ কায়েম রাখা। বিরোধী স্বরকে জায়গা করে দেওয়া! কিন্তু যে ভাবে বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে তাতে মার খেতে পারে অর্থনীতি।’’
দেশের বর্তমান অসহিষ্ণু বাতাবরণ জিইয়ে রাখার নেপথ্যে শাসক দলের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ করেছিলেন মনমোহন। আর আজ প্রকাশ্য মঞ্চ থেকেও বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবার ও তাদের অনুগামী সংগঠনগুলিকে এর জন্য দায়ী করেন তিনি। অভিযোগ করেন, ‘‘কিছু চরমপন্থী সংগঠন বিভাজনের বিষ ছড়াচ্ছে। যে হিংসাত্মক পথে ওই সংগঠনগুলি মানুষের বাক্-স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করছে তাতে গোটা দেশ উদ্বিগ্ন। খাদ্যাভ্যাসে, জাতে বা মতে না মিললেই যে ভাবে মননশীল বিশিষ্ট জনকেও খুন করা হচ্ছে, তা কোনও মতেই বরদাস্ত করা যায় না। মেনে নেওয়া যায় না প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করা চেষ্টা।’’
মাস ছয় আগে মোদী সরকারের অর্থনীতি নিয়ে এক বার ঝাঁঝালো সমালোচনা করেছিলেন মনমোহন। বলেছিলেন, ‘‘নতুন কিছুই হয়নি নয়া জমানায়। মন্দা থেকে দেশকে বার করে আনার চেষ্টাও নড়বড়ে। সরকার বৃদ্ধির কোনও দিশা দেখাতে পারছে না, উল্টে দ্রুত বৃদ্ধির নামে জনকল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাটাও ভেঙে ফেলতে চাইছে।’’ মনমোহনের সে দিনের আক্রমণে তেলেবেগুনে হয়ে উঠেছিল বিজেপি। আজও তাই হয়েছে। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনারায়ণ সিংহ বলেন, ‘‘দেশের মানুষকে মিথ্যা ভয় দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন মনমোহন।’’
বিজেপির আশঙ্কা, সনিয়া-রাহুল সুচিন্তিত ভাবেই সরকারের সমালোচনায় মনমোহনকে এগিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ঘরোয়া মহলে তো বটেই আন্তর্জাতিক স্তরেও অর্থনীতির পণ্ডিত হিসেবে মনমোহনের সুনাম রয়েছে। ফলে মনমোহন কিছু বললে তা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। ক’দিন আগেই আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, অসহিষ্ণু পরিবেশ ভারতে বিনিয়োগের পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। এর উপরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর এই সমালোচনায় আরও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে মোদী সরকার সম্পর্কে।
সন্দেহ নেই, সব রকম ভাবে মোদী সরকারের উপরে চাপ বাড়ানোই লক্ষ্য কংগ্রেসের। সেই কারণেই তারা দেশ জুড়ে অসহিষ্ণু পরিবেশ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা উস্কে দিতে চাইছে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বামপন্থী ইতিহাসবিদ-সহ সমাজের শিক্ষিত অংশের মধ্যে। ১৪ নভেম্বর জওহরলাল নেহরুর জন্মদিনে দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়ামে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। তার আগে আজ ও কাল দিল্লিতে দু’দিনের একটি সম্মেলনও আয়োজন করা হয়েছে। আজ সেই মঞ্চে মনমোহন ছাড়াও ছিলেন ইরফান হাবিব, মুকুল কেশবন, কুমার কেতকর, তিস্তা সেতলওয়াড়, অশোক গঙ্গোপাধ্যায়রা।
শুধু মনমোহন নন, দেশ গঠনে নেহরুর অবদানের কথা বলতে গিয়ে দেশে অশান্তির পরিবেশের সমালোচনা করেন শিক্ষাবিদরাও। ১৯৪৭ সালে আঞ্চলিক সরকারগুলিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর একটি চিঠির অংশও পড়ে শোনান বর্ষীয়ান সাংবাদিক কুমার কেতকর। যে চিঠিতে আরএসএসের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে সতর্ক করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মন্তব্য করেছিলেন, আরএসএসের কাজকর্মে নাৎসি বাহিনীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন তিনি। ইরফান হাবিব বলেন, ‘‘কিছু লোক দেশের ইতিহাস বদলানোর চেষ্টা করছেন। গাঁধী-নেহরুর ঐতিহ্যকে লঘু করে এমন লোকেদের নায়ক বানানো হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের ভূমিকাই ছিল না। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও এমন চেষ্টা হয়েছে, পাঠ্যসূচি বদলের মাধ্যমে।’’
ওই মঞ্চে দাঁড়িয়েই অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে কংগ্রেসকেও কাঠগড়ায় তোলেন শিক্ষাবিদ মুকুল কেশবন। শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। মনে করিয়ে দেন, গোরক্ষা আইন তৈরির পিছনে ভূমিকা ছিল কংগ্রেসেরও। তিস্তা সেতলওয়াড় বলেন, ’৮৪ সালের দাঙ্গা বা তার আগের বছর নেলি হত্যাকাণ্ড দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছিল ঠিকই। কিন্তু এখন পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। এই মুহূর্তে গোটা দেশে সহিষ্ণু বাতাবরণ বিগড়ে দিচ্ছে আরএসএস। বিভাজনকারী সেই শক্তিকে দমন করতে দল নির্বিশেষে সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাই সময়ের দাবি।