গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে।—ছবি পিটিআই।
সাল ২০০১। উত্তরপ্রদেশ। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
কানপুরের শিবলি থানার ভিতরে বিজেপি নেতা সন্তোষ শুক্লকে তাড়া করে ঢুকে পড়ল বিকাশ দুবে। সন্তোষ শুক্ল তখন রাজ্যের প্রতিমন্ত্রীর সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত সরকারি পদে। থানায় অফিসার-হাবিলদার মিলিয়ে ২৫ জন পুলিশকর্মী। তাঁদের সামনেই বিকাশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল সন্তোষের দেহ।
চার মাস পরে বিকাশ যখন আত্মসমর্পণ করল, তখন তার চারপাশে কানপুরের অনেক রাজনৈতিক চরিত্র। আদালতে ২৫ জন পুলিশকর্মীর এক জনও সাক্ষ্য দিতে চাননি। আদালত প্রমাণের অভাবে বিকাশকে ছেড়ে দেয়।
এক দিকে ব্রাহ্মণ। অন্য দিকে গ্যাংস্টার। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে এমন মিশেল বিরল। জাতপাতের রাজনীতির অঙ্কে উত্তরপ্রদেশে উচ্চবর্ণের মানুষই অনেক সময়ে দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির সামনে নিজেদের কোণঠাসা মনে করেন। বিরোধী দলের হোক বা নিজের দলেরই বিরোধী গোষ্ঠীর দলিত নেতাদের সঙ্গে টেক্কা দিতে তাই উচ্চবর্ণের নেতাদের গ্যাংস্টারদের শরণাপন্ন হতে হয়। সেই গ্যাংস্টার যদি নিজেই ব্রাহ্মণ হয়, তা হলে তো পোয়াবারো।
আরও পড়ুন: গ্রেফতার, নাকি ধরা দিল বিকাশ?
জাতপাতের অঙ্ক, রাজনীতির সঙ্গে অপরাধের দুনিয়ার এই রসায়ন মেনেই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বিকাশ দুবের উত্থান। উচ্চবর্ণ-অধ্যুষিত এলাকায় দলিতদের দমিয়ে রাখতে হবে—এই মনোভাব থেকেই বিকাশকে প্রথম রাজনীতিকেরা কাজে লাগাতে শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চৌবেপুরে দু’জন দলিতকে খুনের অভিযোগে প্রথম বিকাশের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু যখনই বিকাশকে খুন বা মারদাঙ্গার অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গিয়েছে, নেতাদের ফোন আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে পুলিশ বিকাশের অপরাধ দেখেও চোখ বুজে থাকতে শুরু করে। ২০০০ সালে তারাচাঁদ ইন্টার কলেজের জমি দখল করে বাজার তৈরির জন্য কলেজের উপাধ্যক্ষ সিদ্ধেশ্বর পাণ্ডেকে খুন করে বিকাশ। এই একটিমাত্র খুনেই দোষী সাব্যস্ত হয়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তাতেও হাইকোর্টে জামিন পেয়ে যায়।
এসপি, বিএসপি, বিজেপি— উত্তরপ্রদেশে যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখনই নিজের সুবিধে মতো দল বদলে ফেলেছে বিকাশ। তার ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলে পরিচিত হরিকৃষ্ণ শ্রীবাস্তব বিজেপি ছেড়ে বিএসপি-তে যোগ দিলে সে-ও দল বদলেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন সব রাজনৈতিক দলের কাছেই বিকাশ গুরুত্ব ও আশ্রয় পেয়েছে। ক্রমশ কানপুর সংলগ্ন এলাকায় বিকাশের ‘দাবাং’ ছড়িয়েছে। এই সুবাদেই ১৫ বছর নিজের গ্রামের প্রধান থেকেছে। তার পরে জেলা পরিষদ সদস্য থেকেছে পাঁচ বছর। এখন তার স্ত্রী রিচা জেলা পরিষদ সদস্য। রিচা এসপি-র আজীবন সদস্যপদ নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। কানপুরের প্রবাদ, বিকাশ বা তার স্ত্রীকে কোনও দিন ভোটের প্রচারে যেতে হয়নি। ইশারাতেই ভোট পড়েছে।
যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বিকাশের মাথার দাম ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা হয়। বিপদ বুঝে বিকাশ বিজেপিতে নাম লেখানোর চেষ্টা করছিল। ঠাকুর সম্প্রদায়ের মুখ্যমন্ত্রীর আমলে ব্রাহ্মণেরা এমনিতেই বঞ্চিত হচ্ছেন বলে আবহ তৈরি হয়েছে। সেই মনোভাব থেকে অনেক ব্রাহ্মণ নেতা বিকাশকে সাহায্য করছিলেন বলেও অভিযোগ। কিন্তু এ বার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বিকাশকে নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন।
বিকাশ অবশ্য হাল ছাড়েনি। বিএসপি হোক বা বিজেপি, কোনও একটি দলের টিকিটে ২০২২-এর বিধানসভা ভোটে লড়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিল সে। আজকের ‘গ্রেফতারিতে’ আপাতত জলে গেল সেই পরিকল্পনা।