রোদে-জলে-হাড়কাঁপানো শীতে অনড় থেকে আন্দোলন সফল। যুদ্ধজয়ী সিংঘু সীমানা। শুক্রবার। ছবি পিটিআই।
ক্ষত শুকোয়নি এখনও। ছ’মাস আগে উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কার্যত নাক কাটা গিয়েছিল ক্ষমতাসীন বিজেপির। তিন হাজারের সামান্য বেশি সংখ্যক জেলা পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে দু’হাজারেরও বেশিতে হেরে গিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল। গ্রামীণ উত্তরপ্রদেশে এই মেজাজ বজায় থাকলে, আগামী বছর লখনউয়ের তখ্তে যোগী আদিত্যনাথ ফিরবেন কী ভাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ গভীর হচ্ছিল দলের কপালে। দেশে সব থেকে বেশি মানুষের বাস যে রাজ্যে, সেখানে চাষিদের ক্ষোভের এই অশনি সঙ্কেতই তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রধান কারণ বলে বিজেপি সূত্রের বক্তব্য।
একই সঙ্গে এ-ও সত্যি যে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদে কৃষি আইন পাশ করানোর পরে একমাত্র অসম ছাড়া আর কোনও ভোটে বিশেষ ভাল ফল করেনি বিজেপি। সম্প্রতি লোকসভা, বিধানসভার উপনির্বাচনেও তাদের ফল আশানুরূপ নয়। বিজেপি শিবিরে এখন প্রধান প্রশ্ন, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় কি কোনও লাভ আদৌ হবে? প্রলেপ পড়বে কি চাষিদের ক্ষতে?
বিরোধী শিবির থেকে কৃষক সংগঠনের নেতা— সকলেই বলছেন, এত দেরিতে আইন প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক লাভ তেমন হবে না। চাষিরা এক বছর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় রাস্তায় বসে থেকেছেন। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী কৃষক নেতাদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কটাক্ষ করেছেন। কৃষি আইনের বিরোধিতাকে ‘বিদেশের ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা’র আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা প্রতিবাদী চাষিদের বিভিন্ন সময়ে খলিস্তানি, মাওবাদী, দেশদ্রোহী, মদ্যপায়ীর তকমা দিয়েছেন। সওয়াল করেছেন ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার। অনেকে এই প্রতিবাদকে কমিশন ও মধ্যসত্ত্বভোগী এজেন্টদের আন্দোলন বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। কৃষকদের বক্তব্য, এই সমস্ত অপমান এক দিন ক্ষমা ভিক্ষা করে ভুলিয়ে দেওয়া শক্ত। দেরি হয়ে গিয়েছে। আগে এই সিদ্ধান্ত নিলে, তা-ও কিছুটা লাভ মিলত।
তবে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ। এসপি নেতা অখিলেশ যাদব, বিএসপি নেত্রী মায়াবতী এবং কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরার মধ্যে আসন সমঝোতার ইঙ্গিত নেই। আপ, আসাদুদ্দিন ওয়াইসিরা মাঠে নেমে বিরোধী ভোট কাটতে পারেন। তৃণমূল কংগ্রেসও উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস নেতাদের দলে টানছে। ফলে চাপে থাকলেও, ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবিরের সুযোগ নিয়ে মোদী-যোগী বাজিমাত করতে পারেন।
তা হলে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দরকার পড়ল কেন?
বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, এই প্রথম উত্তরপ্রদেশের মাটিতে দেখা যাচ্ছে, জাতপাতের অঙ্ক কাজ করলেও, হিন্দুত্বের রাজনীতির ঝাঁঝ কমে গিয়েছে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ শুরু হয়ে যাওয়ায় নতুন করে রাম জন্মভূমি ঘিরে আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তোলা শক্ত। বরং কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, পেট্রল-ডিজ়েলের চড়া দাম, সর্ষের তেল ও আনাজের চড়া দর নিয়ে অসন্তোষ বড় বিপদ হয়ে উঠছে। সে দিকে তাকিয়েই মোদী সরকারকে কৃষকদের ক্ষতে প্রলেপের সিদ্ধান্ত নিতে হল। এতেও কাজ না হলে, আরও কড়া হিন্দুত্বের পথে হাঁটতে হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপি শিবিরে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারের শীর্ষ সূত্রে দাবি, কৃষি আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, খলিস্তানি সংগঠনগুলি আন্দোলনের ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। বিজেপি নেতারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলেও দাবি করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, আজকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। মোদীর এই ঘোষণার আগে সংশ্লিষ্ট কোনও মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। পরে আবার কৃষি আইন ফিরিয়ে আনা হবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, পঞ্জাব থেকে আন্দোলন শুরু হলেও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ বলয়ে কৃষি আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়াই আইন প্রত্যাহারের পিছনে মূল কারণ। সেই সঙ্গে কৃষক নেতাদের অনড় মনোভাবও রয়েছে।
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে ভোটের ঠিক আগে নরেন্দ্র মোদী নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করেছিলেন। রাজনৈতিক শিবিরে প্রশ্ন উঠেছিল, ভোটে নগদ টাকা খরচের সময়ে অখিলেশ, মায়াবতীদের বিপাকে ফেলতেই কি মোদীর এই সিদ্ধান্ত!
অখিলেশ-মায়াবতী বিপাকে পড়েছিলেন কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু গরিব পরিযায়ী শ্রমিক থেকে ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী— বিপাকে পড়েছিলেন খেটে খাওয়া বহু মানুষ। এই অবস্থায় বিজেপিকে উত্তরপ্রদেশের ভোটে ২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইকে সেনার বীরত্বের প্রচার করতে হয়েছিল। হিন্দু, উচ্চবর্ণের সঙ্গে যাদব বাদে অন্য ওবিসি, জাটভ বাদে অন্য দলিতদের পাশে টানতে জাতপাতের সমীকরণের অঙ্ক কষে প্রার্থী দিতে হয়েছিল। অমিত শাহের নেতৃত্বে তাতেই বাজিমাত করেছিল বিজেপি। প্রশ্ন, এ বারও কি কেল্লা ফতে হবে?
বিজেপি নেতারা বলছেন, এ হল অঙ্ক কষে ঝুঁকি। উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিজেপি হারলে, ২০২৪ সালের আগে বিরোধী জোট জল-বাতাস পেয়ে মাথাচাড়া দেবে। ২০২২-এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন রয়েছে। এখন অনেক রাজ্য বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির দখলে। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভায় বিজেপি না হারলেও যদি আসনসংখ্যা অনেকখানি কমে যায়, তা হলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে বেগ পেতে হবে। বিরোধী দলগুলি এককাট্টা হয়ে কাউকে প্রার্থী করলে, সমস্যা তৈরি হতে পারে।
আজ প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, সংসদে আলোচনার মাধ্যমেই তিন কৃষি আইনের বিল পাশ হয়েছিল। কিন্তু বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাস্তবে কেন্দ্র সংখ্যা ও ‘গায়ের’ জোরে বিল পাশ করিয়েছিল। সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি মনে করছেন, মোদী সরকার যদি গত বছর সংসদে বাদল অধিবেশনে নমনীয় মনোভাব দেখাত, কৃষি বিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়ে আপসের চেষ্টা করত, তা হলে আজ পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। প্রধানমন্ত্রীকে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করেও কৃষি আইনের গুণাগুণ করতে হত না। বাস্তবেই দিনের আলো দেখত কৃষি সংস্কার।