আর কয়েক মাস পরেই বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে আজ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনা সংক্রান্ত রিপোর্ট (২০০১-’১১) জনসমক্ষে নিয়ে এল কেন্দ্র। গণনা শেষ হওয়ার চার বছর পরে প্রকাশ্যে এল এই রিপোর্ট।
আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০১১— এই দশ বছরে দেশে মোট জনসংখ্যায় হিন্দুর অংশ ০.৭ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৭৯.৮ শতাংশ হিন্দু। সংখ্যার হিসেবে ৯৬.৬৩ কোটি। এই একই সময়কালে শিখ (০.২%), বৌদ্ধ (০.১%)-দের সংখ্যাও সামান্য কমেছে। খ্রিস্টান ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যার বিশেষ হেরফের হয়নি। মুসলিম জনসংখ্যা ০.৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪.২ শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে ১৭.২২ কোটি।
বিজেপি শিবির থেকে শতাংশের হারে হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস এবং মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল তোলা শুরু হয়েছে। যদিও পরিসংখ্যানবিদরা জানাচ্ছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যা ছিল, এ বারের জনগণনায় সেই হার সবচেয়ে নিম্নমুখী। এ বারে মুসলিম বৃদ্ধি-হার নেমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৬ শতাংশে। আগের দু’টি দশকে যা ছিল ৩২.৮৮ ও ২৯.৫২ শতাংশ। একই সঙ্গে হিন্দু বৃদ্ধি-হার এ বারে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬.৭৬ শতাংশে। আগের দু’টি দশকে যা ছিল ২২.৭১ এবং ১৯.৯২ শতাংশ।
আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে সামনে। এই জনগণনার রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট, শিখ, খ্রিস্টান, জৈনদের মতো অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির বৃদ্ধি-হারও গত কয়েক দশকের তুলনায় এই প্রথম দশ শতাংশের নীচে নেমে গিয়েছে।
হিসেব যা-ই হোক, শতাংশের অঙ্কে মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে রেখেই বিহার নির্বাচনে বিজেপি মেরুকরণের তাস খেলতে চাইছে বলে ইতিমধ্যেই সরব হয়ছে বিরোধী শিবির। লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমারের জোটকে ঠেকাতেই বিজেপি এই মেরুকরণের রাজনীতি করছে বলে অভিযোগ করে জেডিইউ নেতা কে সি ত্যাগি বলেন, ‘‘বিহারের নির্বাচনের আগে এই তথ্য পেশ করে আসলে দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে মেরুকরণ করতে চাইছে বিজেপি। আজ হঠাৎ ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশ করা হলেও জাতিগত সমীক্ষার কাজ কিন্তু এখনও শেষ করে উঠতে পারল না কেন্দ্র!’’ বিহারে বিজেপি বিরোধী জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও একই মত প্রকাশ করেছেন। দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারিও বিরোধীদের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে বলেছেন, ‘‘সামনেই বিহারে ভোট। সে কথা মাথায় রেখেই মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছে কেন্দ্রের শাসক দল।’’
ধর্মভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করলেও জাতিগত জনগণনার রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করেনি কেন্দ্র। অথচ এই রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য দফায় দফায় দরবার করে আসছেন মুলায়ম সিংহ, লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ যাদবের মতো নেতারা। একাধিক বার সংসদে এ নিয়ে সরকারের জবাবদিহিও দাবি করেছেন তাঁরা। বিজেপি-বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, জাতিগত জনগণনার রিপোর্ট সামনে এলে ভোটে বিপাকে পড়তে পারে বিজেপি। সে কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার এই রিপোর্ট এখনই প্রকাশ করছে না বলেও অভিযোগ তাঁদের। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, জাতিগত গণনার কাজ চলছে। শেষ হলেই তা প্রকাশিত হবে। আর ধর্মভিত্তিক জনগণনার ক্ষেত্রে বিরোধীদের তোলা অভিযোগের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, আদমসুমারিতে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে রিপোর্টে। এর পিছনে কোনও রাজনীতি নেই।
রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল কিন্তু মনে করছেন, অঙ্ক কষেই ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনার রিপোর্ট এখন প্রকাশ করল কেন্দ্র। বছর শেষে বিহারে ভোট। এখন এই রিপোর্ট প্রকাশ করার মূল উদ্দেশ্য হল, হিন্দু ভোটকে এক জোট করা। কারণ, বিহারের ২৪৩টি আসনের মধ্যে ৫০টির ভাগ্য সরাসরি নির্ভর করছে মুসলিমদের উপর। এ ছাড়া কমবেশি আরও ২৫-৩০টি আসনে মুসলিমদের প্রভাব রয়েছে। ফলে বিহারের রাজনীতিতে মুসলিমদের সমর্থন সরকারের ভাগ্য গড়ে দিতে অনেকটাই সাহায্য করে। মুসলিমদের বিপুল সমর্থন নিয়েই বিহারে এক সময়ে প্রায় ১৫ বছর রাজত্ব করেছেন লালুপ্রসাদ। বিজেপি নেতৃত্ব আশঙ্কা, তাদের ঠেকাতে এ বারও নীতীশ-লালুর জোটকে ঢেলে ভোট দিতে এগিয়ে আসবে মুসলিম সমাজ। তাই হিন্দু ভোটকে একজোট না করতে পারলে বিহারের গদি দখলের স্বপ্ন কঠিন হবে বলে মনে করছেন রাজ্যের বিজেপি নেতারা।
বিজেপি-বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্যকে হাতিয়ার করে বিহার ভোটের আগে হিন্দু ভোটকে একজোট করার লক্ষ্যেই ওই পদক্ষেপ। যদিও সেই অভিযোগ উড়িয়ে আজ বিজেপি নেতা চন্দন মিত্র বলেন, ‘‘এর সঙ্গে বিহারের নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। সরকার এটা আগেই প্রকাশ করে ফেলতে পারত।’’ যদিও একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি জনগণনায় যে ভাবে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে এবং বাকি সম্প্রদায়ের সংখ্যা বাড়ছে তা হিন্দু নেতৃত্বের কাছে যথেষ্ট চিন্তার।’’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতৃত্ব আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টিকে সামনে রেখে তাঁরা আগামী দিনে পথে নামবেন।