অশোক গহলৌত। —ফাইল চিত্র।
২০০৮-এর ১৩ মে। আচমকাই জয়পুরের পুরনো প্রাচীর ঘেরা শহরের বাসিন্দা মহেন্দ্র সাহুর জীবন পাল্টে গিয়েছিল। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল জয়পুর। তাতেই আহত হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন মহেন্দ্রর স্ত্রী। চোখ মুছে মহেন্দ্র বলেন, ‘‘মারা যাওয়ার আগে পাঁচ বছর কোমায় ছিল আমার স্ত্রী। আমাদের তো কোনও দোষ ছিল না। কিন্তু যে সব সন্ত্রাসবাদীরা বোমা বিস্ফোরণ করাল, তাদের চার জনই ছাড়া পেয়ে গেল কী ভাবে? পুলিশ তা হলে কী করল?”
১৫ বছর আগের সেই বিস্ফোরণে অভিযুক্ত চার ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গিকে রাজস্থান হাই কোর্ট গত মার্চ মাসে বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। অশোক গহলৌতের কংগ্রেস সরকার হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। কিন্তু রাজস্থান বিধানসভা নির্বাচনে সন্ত্রাসবাদীদের বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়াকেই হাতিয়ার করেছে বিজেপি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজস্থানে এসে গহলৌত সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে নরম মনোভাব ও সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলেছেন। বলেছেন, রাজস্থানে রামনবমীর মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে মেরুকরণের রাজনীতি।
কাল, শনিবার রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। মরু-রাজ্যের রাজনীতির তিন দশকের প্রথা, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল। সেই রেওয়াজ বদলাতে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত পণ করেছেন, বিধানসভার ২০০ আসনের মধ্যে ১৫৬টি আসন জিতে কংগ্রেসকে ফের ক্ষমতায় ফেরাবেন। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশে জয় নিয়ে নিশ্চিত কংগ্রেস রাজস্থানেও জিতে এলে লোকসভা ভোটের আগে নতুন করে মনোবল পাবে। গহলৌতের অস্ত্র — চিরঞ্জীবী স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিখরচায় চিকিৎসা, মহিলাদের জন্য গৃহলক্ষ্মী যোজনায় বছরে ১০ হাজার টাকা ভাতা এবং সরকারি কর্মচারীদের পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরানোর মতো সাত নিশ্চয়তা প্রকল্প। এই জনমুখী প্রকল্পের অস্ত্র ভোঁতা করে দিতে বিজেপি রাজস্থান জুড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছে।
জয়পুর থেকে চলুন মেওয়াড়ের উদয়পুরে। গত বছর জুনে বছর পঞ্চাশের দর্জি কানহাইয়া লাল সাহুকে কুপিয়ে খুন করে সেই ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে তুলে দিয়েছিল রিয়াজ আট্টারি ও গউস মহম্মদ। পয়গম্বর সম্পর্কে বিজেপির নূপুর শর্মার কুরুচিকর মন্তব্যকে সমর্থন করে সেই ভিডিয়ো ‘শেয়ার’ করেছিলেন কানহাইয়া। তারপরেই তিনি খুন হন। আততায়ীরা ধরা পড়লেও বিজেপির অভিযোগ, গহলৌতের পুলিশ কানহাইয়ার নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেনি। উল্টো দিকে কংগ্রেস বলছে, অভিযুক্তদের ঘটনার পরেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কানহাইয়ার পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর দুই ছেলে সরকারি চাকরি পেয়েছে।
বিজেপির ‘আইটি সেল’-এর প্রচারে অবশ্য তা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। জয়পুরের টাঙা চালক জব্বর সিংহ বলেন, ‘‘এই তো মাস দুয়েক আগে জয়পুরে দুই মোটরবাইকে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে রামগঞ্জ বাজারের ইকবাল রাজাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। ওঁর বাড়ির লোকেরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। কানহাইয়া লালের পরিবার কিচ্ছু পায়নি।’’ কানহাইয়া লালের পরিবার কিচ্ছু পায়নি কে বলল? জব্বর সিংহের উত্তর, ‘‘হোয়াটসঅ্যাপে পড়েছি। ওখানেই সত্যিটা জানা যায়। টিভি-তে মিথ্যে খবর দেখায়।’’
কংগ্রেসের আশঙ্কা, এই মেরুকরণের সঙ্গে বিজেপি গুর্জর, রাজপুত ভোটেও ভাগ বসাতে পারে। গুর্জর ভোটকে পাখির চোখ করে নরেন্দ্র মোদী নিজেই কংগ্রেসের গুর্জর নেতা সচিন পাইলটের প্রতি অবিচার হয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন। তার জবাবে শুক্রবার অশোক গহলৌত দলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পাইলটের কংগ্রেসের জন্য ভোট চাওয়ার ভিডিয়ো টুইট করেছেন। পাইলটকে ‘কংগ্রেসের তরুণ নেতা’ আখ্যা দিয়েছেন। গহলৌতের প্রশ্ন, ‘‘আমরা সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে নরম মনোভাব নিলে মোদী সরকার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন?”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য অভিযোগ তুলছেন, শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নেও গহলৌত সরকার ব্যর্থ। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের নিরিখে রাজস্থান পয়লা নম্বরে। দৈনিক গড়ে ১৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে রাজ্যে। বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বিজেপি সাংসদ দিয়া কুমারী বলেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে গহলৌত ভোটের আগে নানা প্রকল্প ঘোষণা করছেন। কিন্তু রাজ্যের কোষাগারে টাকা নেই।’’
বিজেপি-র অবশ্য আশঙ্কা, গৃহলক্ষ্মী যোজনায় ১০ হাজার টাকা ভাতার প্রতিশ্রুতি, ৫০০ টাকায় সিলিন্ডারের সুবাদে গহলৌত মহিলাদের ভোটও পাবেন। সেই কারণে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের নিয়মে ক্ষমতায় এলেও বিজেপি নেতারা কেউ বিরাট ব্যবধানে জয়ের আশা করছেন না। উল্টো দিকে গহলৌত নিশ্চিত, তিনি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের রেওয়াজ ভাঙবেন। ভোটগ্রহণের আগের দিন টুইটার-ফেসবুকে নিজের ‘ডিপি’ বদলে ফেলেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, গহলৌত রাজস্থানের মানচিত্র দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছেন। সঙ্গে লেখা, ‘দিল হ্যায় রাজস্থানি’!