‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ থেকে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’— মোদী সরকারের সাফল্যের খতিয়ান জানান দিতে বিজ্ঞাপনের অন্ত নেই। টিভি, খবরের কাগজ, রাস্তার ধারের হোর্ডিংয়ে এই সব বিজ্ঞাপন আমাদের চোখসওয়াও হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞাপনের জন্য সরকারের খরচের বহরটা জানলে কিন্তু সেই চোখই কপালে উঠবে।
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান এনডিএ সরকারের প্রথম এক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনী প্রচারে!
ভারতবর্ষের মতো দেশে ভোটের আগে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প-নীতি নিয়ে বিপুল প্রচার এবং সেই খাতে বহু অর্থব্যয় কোনও নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু, ক্ষমতায় থাকার পাঁচ বছর জুড়েও বিজ্ঞাপনের পিছনে প্রচুর টাকা ঢালার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। অধুনা এনডিএ সরকার শুধু নয়, পূর্বতন ইউপিএ সরকারের আমলেও এই ধারা বজায় ছিল। সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে করা এক আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীন ‘দ্য ডিরেক্টরেট অব অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড ভিস্যুয়াল পাবলিসিটি’ (ডিএভিপি)-র দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষ পর্যন্ত গত ১১ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপনের পিছনে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে হাজার কোটি টাকাই খরচ হয়েছে বর্তমান এনডিএ সরকারের গত এক বছরে।
বিগত ইউপিএ আমলের ছবিটাও বিশেষ আলাদা নয়। কারণ, পরিসংখ্যানের গত ১১ বছরের মধ্যে ১০ বছরই ক্ষমতায় ছিল ইউপিএ। এবং সেই সময়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বিজ্ঞাপনী খাতে সরকারের খরচ। হিসেব বলছে, ইউপিএ আমলে বছরে গড়ে ৫০৪ কোটি টাকা এই খাতে খরচ হয়েছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে যেখানে বছরে এই খরচের গড় ছিল ৩১২ কোটি টাকা, সেখানে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময় বছরে খরচের গড় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ খরচ বাড়ার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি। আর মোদী সরকারের আমলে সরকারি বিজ্ঞাপনের পিছনে বছরে গড়ে খরচ হয়েছে ৯৯৩ কোটি টাকা।
এই খরচের মধ্যে সব ধরনের বিজ্ঞাপনই রয়েছে। অর্থাৎ পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিও, পোস্টার-ব্যানার-হোর্ডিং, স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি, এসএমএস ইত্যাদি। ডিএভিপি-র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এর মধ্যে সিংহ ভাগ খরচই হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন দিতে। গত ১১ বছরে পত্রপত্রিকায় কেন্দ্রীয় সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য খরচের পরিমাণটা হল ৩২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ। এ ছাড়া, দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে ৩৮ শতাংশ এবং অন্য প্রচারের ক্ষেত্রে বাকি ৭ শতাংশ টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে আরও উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ এই দুই অর্থবর্ষের আগে পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপনের খরচ ছিল সর্বাধিক। কিন্তু, গত দুই অর্থবর্ষে টেলিভিশন, রেডিও-র মতো বিভিন্ন দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী প্রচারেই বেশি টাকা খরচ হয়েছে।
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে শুধুমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য এত টাকা কেন ব্যয় করা হবে, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। কারণ, এই টাকার বেশির ভাগটাই তো আমজনতার করের টাকা! এ ক্ষেত্রে সরকারের অবশ্য একটা যুক্তি রয়েছে। তাদের মতে, বিভিন্ন প্রকল্প-পরিকল্পনা তো জনস্বার্থেই করা। ফলে, সব থেকে আগে দরকার সেই সব পরিকল্পনার কথা জনগণকে জানানো। আর বিজ্ঞাপন সেই জন্যই দেওয়া। এতে ফলও মেলে। যেমন, ‘হাম দো হামারে দো’ স্লোগান সামনে রেখে নিবিড় প্রচারের ফলশ্রুতি হিসেবেই জন্মহার বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। এডস্ সচেতনতাতেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বিজ্ঞাপনী প্রচার।
অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্তও মনে করেন কী ধরনের বিজ্ঞাপনের পিছনে সরকার অর্থব্যয় করছে, সেটা আগে দেখা জরুরি। যদি সত্যিই মানুষকে সজাগ করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় তা হলে তা নিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু, শুধু সাফল্যের খতিয়ান জানাতে যদি সরকার বিজ্ঞাপন দেয়, তা হলে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। দীপঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের দেশে পানীয় জল, রাস্তাঘাট, রেল ব্যবস্থা, আবর্জনা সাফাইয়ের মতো অনেক আশু প্রয়োজনীয় কাজ রয়েছে যা বছরের পর বছর করা হয় না। দেশ জুড়ে আরও বেশি সংখ্যক স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল তৈরিও দরকার। সে সব না করে বিজ্ঞাপনের পিছনে বছরে হাজার কোটি টাকা ঢালার মানে হয় না।’’
অর্থনীতিবিদরা আরও মনে করছেন, বিজ্ঞাপনে বিপুল ব্যয়ের মূল কারণ হল ভোটের রাজনীতি। কারণ, আমাদের দেশে কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পরেও তার দলীয় গণ্ডি, হিসেব-নিকেশের বাইরে বেরোতে পারে না। আর তাই সরকারের দায়িত্ব পালনের তুলনায় বড় হয়ে ওঠে ক্ষমতা ধরে রাখার নানা অঙ্ক। দীপঙ্করবাবুরও মত, ‘‘এখন সরকার গড়েই একটা রাজনৈতিক দল হিসেব কষতে থাকে কী ভাবে পাঁচ বছর পরেও তারা ক্ষমতায় আসতে পারে। তাই শুধু ভোটের মুখে নয় বছরভর ফলাও করে সরকার জানান দিতে থাকে তারা কত কী করছে।’’
আসলে এত টাকা খরচ করে সরকারের বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজনটা কী, এটা বিতর্কের বিষয়। দু’পক্ষেই যথেষ্ট যুক্তিও পাওয়া যাবে। কিন্তু, বাস্তবটা হল কোনও সরকার যদি সত্যি কাজ করে, তা হলে তা ঢাক পিটিয়ে প্রচারের প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতাতেই সেই কাজ দেখতে পায়। রাস্তাঘাটে, স্টেশনে পর্যাপ্ত সংখ্যক শৌচাগার হলে মানুষ তো এমনিই তা টের পাবে। তার জন্য টিভির পর্দায় ঘন ঘন বিজ্ঞাপন দেখানোর প্রয়োজন পড়ে কি— প্রশ্নটা কিন্তু ঘুরপাক খাচ্ছেই।