ভারত বায়োটেকের ওয়েবসাইটে ১৬ ডিসেম্বরের কোভ্যাক্সিন-রিপোর্টেও রয়েছে ‘ডিসক্লেমার’(ভিতরের ছবি)— পিয়ার রিভিউ হয়নি, চূড়ান্ত ফল পাল্টাতে পারে।
‘আত্মনির্ভর ভারতের দেশীয়’ টিকার গৌরব হয়তো ষোলো আনা। কিন্তু সায়েন্টিফিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের ‘আন্তর্জাতিক মাপকাঠি’ কোভ্যাক্সিন মানল কোথায়? এই প্রশ্নে ইতিমধ্যেই সরকারকে বিঁধছেন বিরোধীরা। ইতিউতি জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানী মহলেও।
শনিবারই জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে করোনা-টিকা কোভ্যাক্সিন। যৌথ ভাবে যা তৈরি করেছে হায়দরাবাদের সংস্থা ভারত বায়োটেক ও কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)। প্রশ্ন উঠছে, বিজ্ঞান গবেষণার নীতি মেনে এই দেশজ টিকার পরীক্ষার ফলাফল (ট্রায়াল-রিপোর্ট) প্রকাশিত হয়েছে কোন সায়েন্টিফিক জার্নালে? অন্তত রবিবার পর্যন্ত তা ঘোষণা করেনি ভারত বায়োটেক। তাদের ওয়েবসাইটেও এর উত্তর অমিল। বরং নীচের দিকে ‘ডিসক্লেমার’ হিসেবে লেখা রয়েছে: ‘‘কোনও ‘পিয়ার রিভিউ’ হয়নি। অস্থায়ী রিপোর্ট। চূড়ান্ত রিপোর্টে অন্য ফল দেখা যেতেই পারে।’’
ফলে অনেকের প্রশ্ন, তবে কি টিকার ক্ষেত্রে ‘আত্মনির্ভর ভারতের বিজ্ঞাপন’ হিসেবেই গবেষণাপত্র প্রকাশ ছাড়া সায় দেওয়া হল কোভ্যাক্সিন প্রয়োগে? কারণ, সেটি ছাড়া, গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতার একশো শতাংশ গ্যারান্টি কোথায়?
বিজ্ঞানীদের একাংশের বক্তব্য, যদি এক জনকেও এই টিকা প্রয়োগ করা হয়, তাতেও বিজ্ঞানের নীতি মেনে চলা উচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, কোনও গবেষণার রিপোর্ট সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশ করার কারণই হল, গোটা বিশ্বের কাছে গবেষণাটির স্বচ্ছতা বজায় রাখা। অতিমারি পরিস্থিতিতে কী ভাবে প্রচলিত নিয়ম না-মেনে দেশজ ভ্যাকসিনটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। এ-ও বলেছেন, ‘আত্মনির্ভর ভারত’, প্রমাণ করতেই কি এই বেপরোয়া পদক্ষেপ!
বিশ্বে ভ্যাকসিন-দৌড়ে প্রথম তিনে থাকা এক সংস্থার কর্তার কথাতেও, ‘‘খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে বিষয়টি যখন জনস্বাস্থ্য!’’ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন যদিও আজ টুইট করেছেন, ‘‘এই রকম জটিল বিষয়েও রাজনীতি খোঁজা হচ্ছে। লজ্জাজনক!’’
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, যে কোনও ওষুধ বা প্রতিষেধক তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে অ্যানিমাল ট্রায়াল (প্রাণিদেহে পরীক্ষা) ও তাতে সাফল্য মিললে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (মানবদেহে পরীক্ষা) করা হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তিনটি ফেজ় বা ধাপে হয়। প্রতি ক্ষেত্রে পরীক্ষার রিপোর্ট কোনও না কোনও বিজ্ঞান পত্রিকায় (সায়েন্টিফিক জার্নাল) প্রকাশ করতে হয়। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদল নির্দিষ্ট জার্নালে তাঁদের রিপোর্ট জমা দেন। রিপোর্টের দাবির সত্যতা খতিয়ে দেখেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা (একেই বলে, পিয়ার রিভিউ)।
এই পরীক্ষায় পাশ করলে, ওই জার্নালে প্রকাশিত হয় রিপোর্ট। যেমন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার তৈরি করোনা-টিকা চ্যাডক্স১-এর ট্রায়াল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য ল্যানসেট’-এ। ফাইজ়ার-বায়োএনটেক জুটি তাদের ভ্যাকসিনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ। মডার্নার টিকার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ। এই তিনটি ভ্যাকসিনকেই জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ছাড়পত্র দিয়েছে পশ্চিমী দুনিয়া। কারণ, কোনওটিরই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পূর্ণ হয়নি। মূলত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে তৃতীয় ধাপের প্রাথমিক বিশ্লেষণী রিপোর্ট দেখে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘অভিনন্দন ভারত’! মোদী মুগ্ধ, দেশি টিকায় তবু ‘সংশয়’
সে ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি ছিল— প্রথমে গবেষণারত সংস্থা তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। কোনও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সেই রিপোর্ট। তার পরে বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। অথচ ভারত বায়োটেকের ওয়েবসাইটেই লেখা ‘পিয়ার রিভিউ’ হয়নি!
কোভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফেজ়-১ ও ফেজ়-২ সম্পন্ন হয়েছে। ফেজ়-৩ ট্রায়াল চলছে। এ অবস্থায় রবিবার সংস্থার ওয়েবসাইটে দেখা গিয়েছে— ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ফেজ়-১ রিপোর্টের নীচে ‘ডিসক্লেমার’ হিসেবে লেখা: ‘যে সমস্ত তথ্যাবলী দেওয়া হয়েছে, সেগুলির পিয়ার রিভিউ হয়নি। কোনও জার্নালেও প্রকাশিত হয়নি।’ এমনকি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে অ্যানিমাল ট্রায়ালের রিপোর্টের নীচেও ‘আইন বাঁচিয়ে’ একই ‘ডিসক্লেমার’ দেওয়া রয়েছে।
আরও পড়ুন: দুই টিকাই ১১০ শতাংশ নিরাপদ, আশ্বস্ত করলেন ডিসিজিআই
বিদেশি টিকাপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে জরুরি পরিস্থিতিতে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারত বায়োটেকের প্রতিষেধকটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ‘নিয়ন্ত্রিত জরুরি পরিস্থিতি’র কথা মাথায় রেখে। নিয়ন্ত্রিত বলতে ঠিক কী, তা স্পষ্ট করা হয়নি সরকার বা বিশেষজ্ঞ কমিটির পক্ষ থেকে।
প্রকাশ্যে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চট করে রাজি হচ্ছেন না প্রায় কেউই। কিন্তু আর এক বিজ্ঞানীরও বক্তব্য, ওষুধ ও টিকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনও রোগে আক্রান্ত হলে, নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু টিকা দেওয়া হয় সকলকে। ফলে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। অভিযোগ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার যথেষ্ট তথ্য (ডেটা) নেই। সেটি ছাড়া এ ভাবে ছাড়পত্র দিয়ে স্রেফ রাজনীতি করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘অন্দরের খবর, কোনও জার্নালে রিপোর্ট প্রকাশ করা তো দূর অস্ত্, রিপোর্ট লেখার কাজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ করা হয়নি।’’ এই পরিস্থিতিতে শুধু পাল্টা বিবৃতি না-দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়ার পুরো পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের আরও স্বচ্ছ হওয়া উচিত বলে মনে করছেন অনেকে।