শ্রীক্ষেত্রে ঝাঁটার দাপট, আজ রথ টানা হবে যে

এ-ও এক বঙ্গ সম্মেলন! মুঠো করা হাতে পতাকার মতো উঁচিয়ে ধরা খ্যাংরা ঝাঁটা, অন্য হাতে মাটির ঘড়া। কপালে তিলক। খালি পা। আজ, রথযাত্রার ঠিক আগের দিন মিছিল চলেছে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার কালকের রুট ধরে।

Advertisement

ঋজু বসু

পুরী শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৫
Share:

গুন্ডিচা মন্দিরের সামনে চলছে রাস্তা সাফাই। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

এ-ও এক বঙ্গ সম্মেলন!

Advertisement

মুঠো করা হাতে পতাকার মতো উঁচিয়ে ধরা খ্যাংরা ঝাঁটা, অন্য হাতে মাটির ঘড়া। কপালে তিলক।

খালি পা। আজ, রথযাত্রার ঠিক আগের দিন মিছিল চলেছে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার কালকের রুট ধরে। শিলংয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক সাথী চৌধুরী, মুম্বইয়ে কর্মরত শিবানী ঘোষ, টালিগঞ্জের গৃহবধূ ইন্দ্রাণী দাস বা সিইএসসি-র অফিসার সোমনাথ দাস—কে নেই মিছিলে।

Advertisement

পুরীপাগল হুজুগে বাঙালির সঙ্গে এই জনতাকে এক করে দেখলে ভুল হবে। হাতে ঝাঁটা দেখে নরেন্দ্র মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ বা অরবিন্দ কেজরীবালের দলের নির্বাচনী প্রতীকের কথা ভুলেও ভাববেন না। মুগবেড়িয়ার নন্দ-বাড়ির ছোট ছেলে, ভক্ত চৈতন্যময় নন্দ যেমন হেসে বললেন, ‘‘ধুর, ধুর মোদী, কেজরীরা তো সে-দিনের ছেলে। সম্মার্জনী

হাতে অন্তরে-বাইরে সাফসুতরো করার ভাবনা চৈতন্য মহাপ্রভু কবেই ভেবে রেখেছিলেন।’’

লোকান্তরিত হওয়ার আগে প্রায় অর্ধেক জীবন এই নীলাচলেই কাটান শ্রীচৈতন্য। জগন্নাথদেবের রথের পুরোভাগে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ভাববিহ্বল নিমাই-ই তখন ছিলেন শোভাযাত্রার মুখ্য মুখ। আর রথের আগের দিন জগন্নাথদেবের গন্তব্য, গুন্ডিচা মন্দির পরিষ্কার করার দায়িত্বও তিনি স্বয়ং কাঁধে তুলে নেন। চৈতন্যের সেই লীলাই মূর্ত করে তোলার টানে দেশ-বিদেশের ভক্ত বঙ্গসন্তানরা আজও রথের আগে গুন্ডিচায় জগন্নাথের ‘পাইলট’ হয়ে ওঠেন।

বৈষ্ণব ভক্তদের পরিভাষায়, কয়েক শো বছরের এই আচার হল গুন্ডিচা সম্মার্জন। আর নবকলেবরের নতুন জগন্নাথের রথযাত্রার আগে গুন্ডিচার ভিড়টাই বুঝিয়ে দিল, কাল রথে পুরীর চেহারাটা কী হতে চলেছে।

দমদমের শ্যালিকা-জামাইবাবু পাপিয়া ও হরিভূষণ সাহা ভিড় ঠেলে কোনও মতে গুন্ডিচায় ঢুকে শক্ত করে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু মায়াপুরের বেণুপ্রিয়া ও তার মা ভিতরে ঢুকতেই জেরবার। শিলংয়ের সাথীদেবীর দিদি ভিতরে ঢুকে গেলেও তিনি মন খারাপ করে ঝাঁটা হাতে বাইরেই দাঁড়িয়ে। ঢাকার বৃদ্ধা সাহারানি সরকারও অসুস্থ শরীরে মন্দিরের ভিতরে ঢোকার ঝুঁকি নিলেন না। গেটে ঠেলাঠেলির চোটে তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন দুই প্রৌঢ়া। মা ভিতরে ঢুকে গিয়েছেন, আকুল হয়ে কাঁদছে একা কিশোরী।

বেগতিক দেখে ভিড় সামলাতে মন্দিরের ফটকের পুলিশ ভক্তদের ঝাঁটা কেড়ে নিয়েই ভিড়ের উপর ঝাঁটা চার্জ শুরু করল। মন্দিরের ভিতরে ভক্তকুলের অবশ্য এ সব জাগতিক ঝঞ্ঝাটে ভ্রূক্ষেপ নেই। বাইরে ইস্কনের ভক্তরাও রোদে দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে নাচ-বিহ্বল ভঙ্গিতে কৃষ্ণ-নামে মাতোয়ারা। গুন্ডিচার ভিতরে, আনন্দবাজারে (ভোগ বিতরণের মঞ্চ) আজ বসেছে কীর্তনের আসর। মানিকতলার প্রভু জগদ্বন্ধু মঠের বাবাজিরা ঘুরে-ফিরে ধুয়ো তুলছেন, ‘কেহ জল ঘট দেয় মহাপ্রভুর করে/কেহ ছলে জল দেয় চরণ উপরে’।

ব্রহ্মচারীরা বলছিলেন, কী ভাবে রাজপুরোহিত কাশীনাথ মিশ্রকে বলে গৌরাঙ্গ গুন্ডিচা সম্মার্জনীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কয়েক দিনের গুন্ডিচাবাসে জগন্নাথ তথা কৃষ্ণ যেন ব্রজে ফিরে রাসলীলায় মাতেন। গৌরাঙ্গের নেতৃত্বে রাধা ভাবে ভক্তরা গোপিনীর মতো আবেগে মন্দির পরিষ্কারে মাতেন। এর ঠিক দু’দিন আগে গৌরাঙ্গের নির্দেশেই বাঙালি ও ওড়িয়া ভক্তদের মিলন সমারোহ ঘটত পুরীতে। আজও ওড়িয়া ভক্তরা গৌড়ীয় ভক্তদের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন। আর তার পর দিনই নিমাইয়ের যাবতীয় প্রিয় আহার্য, রোজকার সামগ্রী বাঁশের ডালিতে (ঝালি) ভরে এই জগন্নাথধামে আনতেন তাঁর প্রিয় পার্শ্বদ রাঘব পণ্ডিত। নিমাইয়ের স্মৃতিধন্য রাধামাধবের গম্ভীরা মঠে এখনও ঝালি অর্পণের অনুষ্ঠান হয়।

স্বয়ং রাঘবপণ্ডিতের বংশধর শ্রীগোবিন্দ গোস্বামী, শ্রী রাধাগোবিন্দ গোস্বামীদের দেখে এ কালের ভক্তরা হয়তো উদ্বেল হয়ে স্মার্টফোনে নিজস্বী তুলে রাখছেন। কিন্তু আচার-অনুষ্ঠান আজও অবিকল আগের মতো।

ভক্ত শিবানীদেবী বলছিলেন, পুরীর জলে শ্রী গৌরাঙ্গের প্রায়ই পেট খারাপ হতো। রাঘব পণ্ডিতের বোন দময়ন্তী, তাই তাঁর জন্য করলা, আমলা, নিমপাতা ইত্যাদি সর্ষের তেলে ভেজে শুকিয়ে শুকনো-শুকনো ‘রেডি-টু-ইট’ শুক্তো তৈরি করে দিতেন। গরম ঘি-ভাতে তা মেখে খেতে নাকি অমৃত!

পুরীতে গৌরাঙ্গের সারা বছরের রেশন এই রথের সময়েই আসত। এ বারও ভক্তদের আনা সব্জি, রকমারি আচার-পাঁপড়-নিমকি, মিষ্টিতে গম্ভীরা মঠ উপচে পড়ছে। বরাহনগরে রাঘবের পাঠবাড়ির আশ্রিত ভক্ত ইন্দ্রাণীদেবী আবার নিমাইয়ের কথা ভেবেই নাড়ু করে এনেছেন। দময়ন্তী নাকি গৌরাঙ্গের শৌচকর্মের জন্য গঙ্গামাটি শুকিয়ে ঝুরঝুরে পাপড়ি বানিয়ে কর্পূর, চন্দন মিশিয়ে গুঁড়ো সাবান প্রস্তুত করতেন। তার ব্যবস্থাও করেছেন ইন্দ্রাণী।

গুন্ডিচা সম্মার্জনীর আগেই আজ আকাশভাঙা বৃষ্টি। তার মধ্যেই সব সামগ্রী মাথায় করে ঝাঁঝা পিটা মঠ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদুয়ার পেরিয়ে বাঙালি ভক্তদের মিছিল প্রথমে গেল গম্ভীরা মঠে। সেখানে চৈতন্যের খড়ম প্রণাম করার পরে আজকের গুন্ডিচা-অভিযান। গুন্ডিচায় জগন্নাথের সিংহাসন নিজের হাতে পরিষ্কার করার পরে গৌরাঙ্গের ধূলিধূসরিত কান্তির কী অপরূপ আভা হয়েছিল, তা লেখা আছে চৈতন্য চরিতামৃতে। সে-কথা বলতে বলতে এই ২০১৫-র ভক্তদের চোখও চিকচিক করে উঠছে।

শুধু মেলায় বৃষ্টি বা পাঁপড়ভাজা নয়। নিমাইয়ের স্মৃতিতেও বহু বাঙালির রথযাত্রার ভাঁড়ার উপচে পড়ে। বহু যুগ আগে জন্মস্থান থেকে দূরে হারিয়ে যাওয়া বাংলার এক ঘরের ছেলের প্রতি শিকড়ের টানও পুরীর রথযাত্রার এক অমোঘ আকর্ষণ।

মূল মন্দিরের বাইরের ছবিটা আজ আবার একটু অন্য রকম। সকাল থেকে বন্ধ মন্দিরের সিংহদুয়ার। আর তার বাইরে গিজগিজে জটলা। আলোচনা চলছে, কাল কে কী ভাবে রথযাত্রা দেখবেন। দুপুরের দিকে মন্দিরের দরজা খুললেও ওড়িশা পুলিশের কম্যান্ডোদের পাহারার বজ্রআঁটুনি। বড়জোর জয়বিজয় দরজার সিঁড়িটুকু দেখা যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়েই দু’হাত তুলে কেঁদে আকুল হচ্ছেন ভক্তকুল। বেলা বারোটা নাগাদ মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র তাঁর শাড়ির দোকানে বসে সুসংবাদ দিলেন। নেত্রদর্শন, নবযৌবন দর্শন সব হয়ে গিয়েছে। ‘‘প্রভুর ইচ্ছে। সব কিছুই ঠিক সময়ে চলছে।’’ দুপুরে মন্দিরের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক সুরেশ মহাপাত্রের গলাতেও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মেজাজ! ‘‘কোনও বিঘ্ন নেই। প্রভু এখন লাঞ্চ করছেন। দফায় দফায় ভোগ, সন্ধ্যারতির প্রস্তুতিও সারা,’’ ফোনে বললেন মহাপাত্র।

এর কিছু ক্ষণ আগেই মন্দিরের ঘোড়া দরজায় দেখা দ্বাররক্ষী প্রবীণ রামচন্দ্র প্রতিহারীর সঙ্গে। বললেন, ‘‘দেড় মাস বাদে প্রভুকে দেখলাম।’’ তার পরই সদ্য পরিচিত প্রশ্নকর্তার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘‘তুমি ঢুকতে পারবে না।’’ ভিন্‌ রাজ্যের সাংবাদিক তো কোন ছার, মন্দিরে ফুল মালা তৈরির কাজ করেন, রুক্মিণী দেবী পর্যন্ত পিছনের দক্ষিণ থেকে পুব দরজায় ঘুরে ঘুরে হত্যে দিচ্ছেন। এর মধ্যেই যেন কী ভাবে রটে গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ঝটিতি দর্শন সারতে চলে এসেছেন। মন্দিরের মুখ্য প্রশাসককে সে-প্রশ্ন করতেই তাঁর মুখ গম্ভীর, ‘‘খেপেছেন, সিএম-এরও ঢোকার অনুমতি নেই।’’

কাল সকালের আগে মন্দিরের সেবায়েত, কর্মচারী ছাড়া কেউ মূল মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে পারবেন না। তার পরেও বিগ্রহের রথে পদার্পণ বা ‘পাহুন্ডি বিজয়’ চাক্ষুষ করতে যাঁরা টিকিট কেটেছেন, তাঁরা ছাড়া কারও ঢোকা নিষেধ। শুক্রবার সকাল সাতটাতেই সিংহদুয়ারে মন্দিরের অফিস পর্যন্ত বড় দণ্ড বা গ্র্যান্ড রোড ধরে আধ কিলোমিটারটাক লম্বা লাইন। ‘পাহুন্ডি বিজয়’ দেখতে টিকিট কাটার লাইন। সামনের দিকে দাঁড়ানো মানিকতলার ববিতা সাহু বললেন, ‘‘ভোর চারটের থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’’ টিকিটের লাইন অবশ্য বেলা ১২টার মধ্যে মন্দিরের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। পুলিশের কাছে খবর এসেছে, সব আচার শেষ। এ বার জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রার থেকে তিন-তিনটে ‘আজ্ঞা মালা’ নিয়ে ব্রাহ্মণ পূজাপাণ্ডারা রথের কাছে যাবেন।

মন্দিরের দ্বারে রথ আসা যেন উত্সবের ফাইনাল রাউন্ডের বোধন। যুগ যুগ ধরে এক দৃশ্য। কিন্তু উন্মাদনা চিরনতুন। অন্তর্যামীর ঠিকানা অন্তর্যামীই জানেন। আপাতত রথে মূর্তিরও দেখা নেই। তবে পথ, রথ বা রথের রশি সকলেই এই জগন্নাথক্ষেত্রে আজ দেবতা হয়ে উঠেছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement