—ফাইল চিত্র।
‘তোমরা একটা মুম্বই করতে পারো, কিন্তু বালুচিস্তান হারাতে হবে।’
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের ‘ডক্ট্রিন’ (নীতি) এটিই। বরাবরই ‘ফিল্ডে’ কাজ করে আসা ডোভাল শান্তি আলোচনার পরিবর্তে জঙ্গি দমনে জোর দিতেই পছন্দ করেন। পাকিস্তান কাশ্মীরে জঙ্গি পাঠালে পাল্টা মারের নীতিতে বিশ্বাসী ডোভালের হাতেই তাই কাশ্মীরের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু কাশ্মীরে ডোভালের কড়া দাওয়াই প্রয়োগের ফল হিতে বিপরীত হয়েছে বলে এখন মনে করছেন শাসক শিবিরেরই অনেকে। জঙ্গি নিকেশ করতে গিয়ে উল্টে গত পাঁচ বছরে সেনা কনভয় ও ছাউনির উপরে দেড় ডজন জঙ্গি হামলার সাক্ষী থেকেছে এ দেশ। পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে চারশো জওয়ানের মৃত্যুতে রক্তাক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ। যার মধ্যে রয়েছে গত কালের পুলওয়ামার হামলা, যাতে মারা গিয়েছেন ৪৯ জন জওয়ান। উরি-পঠানকোট-ডোকলাম-মায়ানমারের পরে পুলওয়ামার জঙ্গি হামলায় ফের প্রশ্নের মুখে ডোভাল (দমন) নীতি।
পুলওয়ামার ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে একাধিক ফাঁকফোকর। গোয়েন্দা বিভাগ ও নিরাপত্তাবাহিনীর সমন্বয়হীনতা তার মধ্যে অন্যতম। গোয়েন্দারা আড়ি পেতে জানতে পেরেছিলেন, কনভয়ে আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জঙ্গিরা। অভিযোগ উঠেছে, সাত দিন আগে আসা ওই সতর্কবার্তা নিয়ে মাথাই ঘামাননি কেউ। এমনকি সূত্র বলছে, গত কাল জম্মু থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত কয়েকশো কিলোমিটার যাত্রাপথে একাধিক স্থানে জঙ্গিরা কনভয়ের গতিবিধি নিয়ে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করেছে। আড়ি পেতে সেই তথ্য জানতে পারলেও আগের সতর্কবার্তার মতোই এটিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে একটি সূত্রে অভিযোগ। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজ্যপালের বকলমে কেন্দ্রের শাসনে থাকা উপত্যকায় বসে আত্মঘাতী জঙ্গি আদিল আহমদ দার কী ভাবে কয়েকশো কেজি আরডিএক্স জোগাড় করল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশ্নে ৭৮ গাড়ির কনভয়ও। কারণ এত বড় কনভয় হলে বিপদের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হয়েছেও তা-ই। আরও একটি বিষয় নিয়ে নানা মহলে জল্পনা চলছে। তা হল পুলওয়ামায় কনভয়ে থাকা গাড়িগুলির মধ্যে দূরত্ব কি কম ছিল? না-হলে বিস্ফোরণে পরপর দু’টি গাড়ি কেন এত ক্ষতিগ্রস্ত হল? নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সব সময়েই কনভয়ের গাড়িগুলির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ব্যবধান থাকার কথা। একটি সূত্রের দাবি, যদি পুলওয়ামার ক্ষেত্রে সেই ব্যবধান না-মানা হয়ে থাকে, তা হলে তা বড় ধরনের বিচ্যুতি।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা সম্পর্কে এগুলি জানেন?
গত কাল শ্রীনগরগামী কনভয়টি চলাকালীন পাশের রাস্তাটি (জম্মুমুখী) আমজনতার গাড়ি চলাচলের জন্য খোলা রাখা হয়। যার সুযোগ নিয়ে উল্টো দিক থেকে গাড়ি নিয়ে কনভয়ে ঢুকে হামলা চালায় আত্মঘাতী জঙ্গি। হামলার পরে ত্রুটি সংশোধনে নেমেছে সরকার। আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কনভয়ের সুরক্ষার দিকটি মাথায় রেখে উভয় রাস্তাই বন্ধ থাকবে।’’ উপত্যকার মতো এলাকায় যেখানে গত এক বছরে কনভয়ের উপরেই অন্তত পাঁচ থেকে ছ’টি হামলা হয়েছে সেখানে কেন ওই পদক্ষেপ আগে করা হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ফুঁসছে গোটা দেশ। কিন্তু দায়িত্ব কার? গাফিলতির জবাবদিহি কে করবেন, সেই উত্তর জানা নেই কারও।
আরও পড়ুন: ‘বহুত বড়ি গলতি’, পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষার হুঁশিয়ারি মোদীর, সেনাবাহিনীকে ‘স্বাধীনতা’
সরকারি ভাবে কাশ্মীরের ভার কেন্দ্রের হাতে। কিন্তু দেড় বছর আগে অমরনাথ যাত্রীদের হামলার সময়ে রাজনাথ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কাশ্মীর নীতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নয়, আসলে দেখেন ডোভাল। শুপঠানকোট সেনা ছাউনিতে জঙ্গি নিকেশ প্রশ্নে সেনার পরিবর্তে এনএসজি কম্যান্ডোদের উপরে ভরসা করার জন্য ডোভালের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও। ওই অভিযানের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে সেনা-এনএসজি ও বায়ুসেনার গরুড় কম্যান্ডো বাহিনীর মধ্যে তীব্র সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। অহেতুক দীর্ঘতর হয় অভিযান। বাড়ে ক্ষয়ক্ষতি।
ডোভাল তথা তাঁর নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দাবাহিনীর মূল কাজটি কী, তা নিয়ে মোক্ষম প্রশ্ন তুলেছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খান। তিনি বলেন, ‘‘দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যদি মমতা, রবার্ট বঢরা, অখিলেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, গোয়েন্দাদের যদি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়, তা হলে এ ধাঁচের ঘটনা ঘটবেই।’’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মতো বিষয়ের চেয়ে ডোভাল বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক কাজে। নাম না করে ডোভালের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরেও।
শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে ডোভালের নীতি। মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই কাশ্মীর-সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামলানোর দায়িত্ব ছেড়েছিলেন ডোভালের হাতে। ফলে সরকারের নানা মন্ত্রকের সঙ্গে দফায় দফায় মতবিরোধ হয় তাঁর। অভিযোগ ওঠে, ডোভালের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হওয়ার। কার্যত সব ক্ষেত্রেই আগ্রাসী মনোভাব নেওয়ায় শুধু পাকিস্তান বা চিন নয়, নেপাল-ভূটানের মতো ছোট রাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে নয়াদিল্লির। লেজেগোবরে হতে হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়েও। সেখানেও অভিযোগের তির ডোভালের দিকেই।