Sushant singh rajput

রাজনীতি তীব্র সুশান্তের মৃত্যু ঘিরে, মুখোমুখি সঙ্ঘাতে দুই রাজ্য

সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক হাওয়া প্রথমে গরম হতে শুরু করেছিল বলিউডি শহর মুম্বইয়ে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২০ ১৮:৫৫
Share:

সুশান্তের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাওয়া যে ভাবে ক্রমশ গরম হচ্ছে এখনও, তার নেপথ্যে যে রাজনৈতিক অঙ্কও বিস্তর, সে নিয়ে কোনও ধন্দ নেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কেটেছে ছ’সপ্তাহ। ১৪ জুন দুপুরে বলিউড স্টার সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুসংবাদ টিভির পর্দায় ভেসে উঠতেই কেঁপে গিয়েছিল গোটা দেশ। আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে হইচই শুরু হয়েছিল মুম্বইয়ের অভিজাত আবাসনে তরুণ অভিনেতার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে। তবে অন্য সব অঘটনের ক্ষত যেমন মিলিয়ে যেতে শুরু করে সময় খানিকটা কাটলেই, সুশান্তের মৃত্যুর ক্ষেত্রে কিন্তু তা হল না। বরং ঠিক উল্টোটাই ঘটছে এ বার। বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। দুই রাজ্যের পুলিশ পরস্পরের সঙ্গে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। তর্ক তুঙ্গে উঠছে ক্রমশ। আত্মহত্যা, নাকি খুন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু সুশান্তের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাওয়া যে ভাবে ক্রমশ গরম হচ্ছে এখনও, তার নেপথ্যে যে রাজনৈতিক অঙ্কও বিস্তর, সে নিয়ে কোনও ধন্দ নেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক হাওয়া প্রথমে গরম হতে শুরু করেছিল বলিউডি শহর মুম্বইয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক তৎপরতার ভরকেন্দ্র ক্রমশ সরে যাচ্ছে সুশান্তের নিজের রাজ্য বিহারে। মুম্বই পুলিশের তদন্তে বিশ্বাস নেই, তদন্ত করাতে হবে সিবিআই-কে দিয়ে— এই দাবিতে এখন গলা মেলাতে শুরু করেছে বিহারের প্রায় সব রাজনৈতিক দল।

বিহারে তৈরি হতে থাকা এই জনমত, মহারাষ্ট্র সরকারের জন্য খুব অস্বস্তিকর হয়তো হত না। বিহারের ঘটনাপ্রবাহকে পাত্তাই না দিয়ে মুম্বই পুলিশকে দিয়ে স্বচ্ছন্দে তদন্ত চালিয়ে যেতে পারতেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী তথা শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে। কিন্তু বিজেপি সে সুযোগ দিল না উদ্ধবকে। এককালের জোটসঙ্গী তথা বর্তমানের প্রতিপক্ষ শিবসেনার অস্বস্তি বাড়াতে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসও তোপ দাগতে শুরু করলেন। সিবিআই তদন্তের দাবিকে তিনিও সমর্থন করতে শুরু করলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: স্বচ্ছ তদন্ত চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি সুশান্তের দিদির

বিহারের ভূমিপুত্র ছিলেন সুশান্ত। সুতরাং দেশজোড়া জনপ্রিয়তায় সওয়ার হতেই বিহারি অস্মিতার অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। এ হেন সুশান্তের মর্মান্তিক পরিণতি বিহারকেই নাড়া দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর সুশান্তের মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধোঁয়াশা বা ধন্দের তত্ত্ব যত চর্চায় এসেছে, তত বেশি করে আক্রোশ তৈরি হয়েছে বিহারি জনমানসে। আত্মহত্যা সুশান্ত করেননি, তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে কোনও অন্য রহস্য রয়েছে— এই মত হু হু করে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিহারে। আর সেই তত্ত্বে সিলমোহর লাগিয়ে সুশান্তের বাবা বিহার পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতেই মৃত অভিনেতার নিজের রাজ্যে ক্ষোভের স্রোত বয়ে যেতে শুরু করেছে। পুলিশি তদন্ত চলবে না, মুম্বই পুলিশের উপরে তো একেবারেই ভরসা নেই, তদন্ত সিবিআই-কে দিয়েই করাতে হবে— এমন দাবিতে বিহারে পথে নামতে শুরু করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘জাস্টিস ফর সুশান্ত’ হ্যাশটাগ হু হু করে ভাইরাল হয়েছে বিহারে।

Advertisement

আরও পড়ুন: সন্ধান মিলছে না রিয়ার, খুঁজে বার করার চেষ্টা চলছে, বলল বিহার পুলিশ

বিজেপি তো বটেই, বিহারের প্রধান শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেডিইউ-ও মুম্বই পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে নারাজ। মুখ খুলেছেন এনডিএ-র আর এক শরিক এলজেপি-র অন্যতম শীর্ষনেতা তথা রামবিলাস পাসওয়ানের ছেলে চিরাগ পাসওয়ানও। তিনিও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর দাবি তুলেছেন। একই দাবিতে সরব হয়েছেন জন অধিকার পার্টির নেতা পাপ্পু যাদবও।

সুশান্তের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিহারে ক্ষোভের আঁচ কী রকম, তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি সে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল আরজেডি-রও। লালুপ্রসাদের ছেলে তথা বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবও সাংবাদিক বৈঠক করে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আরজেডি-ও সিবিআই তদন্তই চাইছে বলে তেজস্বী জানিয়েছেন। তবে যে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে সুশান্ত ইস্যুতে এনডিএ-র সুরে সুর মেলাতে তেজস্বী বাধ্য হলেন, সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে বিঁধতেও ভোলেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রী কেন এখনও দেখা করলেন না মৃত অভিনেতার পরিজনদের সঙ্গে, প্রশ্ন তুলেছেন লালু-পুত্র।
মহারাষ্ট্রের সরকার কিন্তু সিবিআই তদন্তের পক্ষপাতী নয়। মুম্বই পুলিশ উপযুক্ত তদন্তই করছে বলে উদ্ধব সরকারের দাবি। কিন্তু শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট সরকারকে বিপাকে ফেলতে বিজেপি-ও কম তৎপর নয়। যদি চাপা দেওয়ার কিছু না-ই থাকে, তা হলে এই মৃত্যুর তদন্তের ভার সিবিআই-কে দিতে আপত্তি কিসের? প্রশ্ন তুলছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি। মহারাষ্ট্র বিধানসভার বর্তমান বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস তো বলতে শুরু করেছেন যে, সিবিআই তদন্ত হোক বা না হোক, ইডি তদন্ত তো হবেই। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের আর্থিক লেনদেনেও যে হেতু চর্চায় চলে এসেছে, সে হেতু বিষয়টি ইডি-র এক্তিয়ারের মধ্য পড়ছে বলে ফডণবীসের মত।

দেবেন্দ্র ফডণবীসের এই বয়ান কিন্তু এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সক্ষম। প্রথমত, এই বয়ান দিয়ে তিনি অস্বস্তি অনেকটাই বাড়িয়ে দিতে পেরেছেন নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ উদ্ধব ঠাকরের। দ্বিতীয়ত, বিহারে নির্বাচন সামনেই। ফডণবীসের এই বয়ানকে হাতিয়ার করে বিজেপি বিহারবাসীকে বোঝাতে শুরু করেছে যে, সুশান্তের জন্য শুধু বিহারের বিজেপি গলা ফাটাচ্ছে না, মহারাষ্ট্রেও বিজেপি সমান ভাবে সরব।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিজে এখনও সিবিআই তদন্তের দাবি তোলেননি। কিন্তু সুশান্তের বাবা অভিযোগ দায়ের করতেই নীতীশ দ্রুত সক্রিয় করে তুলেছেন নিজের পুলিশকে। বিহার পুলিশের একটি দলকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন মুম্বই। সেই দল ইতিমধ্যেই মুম্বইতে জনা ছয়েককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা বিহার পুলিশের রয়েছে। আর সে সবের মাঝে বিহার পুলিশ আর মুম্বই পুলিশ সঙ্ঘাতে জড়ানোয় রাজনীতি আরও তীব্র হয়েছে। বিহার পুলিশের যে প্রতিনিধি দল মুম্বইতে গিয়েছে, সেই দলকে কাজ করতে দিচ্ছে না মুম্বই পুলিশ, অভিযোগ বিহার সরকারের। বিহার পুলিশের প্রতিনিধিদের প্রিজন ভ্যানে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সত্যিই ঘটিয়েছে মুম্বই পুলিশ। তীব্র বিতর্ক শুরু হতে মুম্বই পুলিশ জানিয়েছে যে, বিহার পুলিশের প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই ওটা করা হয়েছিল। তবে সে সাফাইতে বিতর্ক থামছে না।

সিবিআই তদন্তের বিষয়ে নীতীশ কী ভাবছেন? বিহার মুখ্যমন্ত্রীর জবাব— সুশান্তের বাবা নিজে তো এখনও সিবিআই তদন্তের দাবি তোলেননি, দাবি তুললে তখন দেখা যাবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতীশ নিজেও সিবিআই তদন্ত চান না। যতক্ষণ বিহার পুলিশের হাতে মামলার তদন্তভার থাকছে, ততক্ষণ সব নীতীশের নিয়ন্ত্রণে থাকছে। আর জনমতকে এমন সাঙ্ঘাতিক ভাবে প্রভাবিত করতে পারে যে ইস্যু, তার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চাইবেন না কোন রাজনীতিক! ঠিক একই কারণে, শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসও ইস্যুর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রাখতে চাইছে। মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
সামনেই নির্বাচন বিহারে। অতএব সুশান্ত ইস্যু এখন সহজে ঠান্ডা হওয়ার নয়, মনে করছে রাজনৈতিক শিবিরেরই বড় অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement