(বাঁ দিকে) রাহুল গান্ধী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ কি আর টিকবে? ফাটল স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে ‘বড়’ শরিকের সঙ্গে ‘মেজো’ এবং ‘সেজো’র। ফাটল বাড়তে বাড়তে ভাঙনে গড়াবে কি? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
মঙ্গলবার একই দিনে সংসদের ভিতরে বাইরে অন্তত তিনটি ঘটনা ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক দল কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল। কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলল সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-ও।
ঘটনা এক: সংসদ চত্বরে আদানিদের ‘ঘুষকাণ্ডের’ প্রতিবাদে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ দেখালেন কংগ্রেস এবং বিরোধী জোটের কিছু ‘ছোট’ শরিক দলের সাংসদেরা। কর্মসূচিতে যোগ দিল না তৃণমূল এবং এসপি। আম আদমি পার্টি (আপ)-এরও কাউকে দেখা যায়নি।
ঘটনা দুই: তৃণমূলের এই অনুপস্থিতি নিয়ে যখন জল্পনাকল্পনা চলছে, সেই সময় দলের সাংসদ কীর্তি আজাদের একটি মন্তব্যকে ‘মশকরা’ বলে কটাক্ষ করে ফেলল কংগ্রেস। বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ কীর্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ইন্ডিয়া’র মুখ করার দাবি তুলে সম্প্রতি বলেছিলেন, “একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই হারতে হয় বিজেপিকে। উপনির্বাচনেও মমতাদিদি ছক্কা মেরে নরেন্দ্র মোদীকে পশ্চিমবঙ্গের বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।” ক্রিকেটের অনুষঙ্গ টেনে মমতাকেই ‘জোটের মুখ’ করার দাবি তুলেছিলেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন এই ক্রিকেটার। কিন্তু কীর্তির এই মন্তব্যকে ভাল ভাবে নেয়নি কংগ্রেস। দলের তামিলনাড়ুর সাংসদ মণিকম টেগোর মঙ্গলবার খোঁচার সুরেই বললেন, “এটা খুব সুন্দর একটা মশকরা।”
ঘটনা তিন: বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তৃণমূলনেত্রীর ‘ধ্যানধারণা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন কেরলের কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ‘পণ্ডিত’ বলে পাল্টা কটাক্ষ করলেন শশীকে। বাংলাদেশে চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারি এবং সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগে গত কয়েক দিন ধরেই দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনা (পিস কিপিং ফোর্স) পাঠানোর জন্য কেন্দ্র আর্জি জানাক বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মঙ্গলবার সংসদ চত্বরে শশী মমতার মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, “আমি ঠিক জানি না উনি (মমতা) রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনার ভূমিকার বিষয়টি পুরোপুরি বোঝেন কি না। আমি বহু বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনায় কাজ করেছি। আমি এটা বলতে পারি যে, সংশ্লিষ্ট দেশ নিজে না-চাইলে খুব কম ক্ষেত্রেই কোনও দেশের ভিতরে শান্তিসেনা যায়।” তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ পাল্টা বলেন, “উনি (শশী) তো অনেক বড় পণ্ডিত। তা উনি আমাদের নেত্রীকে কটাক্ষ না-করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?”
সংসদের চলতি অধিবেশনের গোড়া থেকেই বিরোধীদের সে ভাবে কক্ষ সমন্বয় করতে দেখা যায়নি। এমনকি কক্ষ সমন্বয় এবং সংসদে ‘ইন্ডিয়া’র রণকৌশল ঠিক করতে যে বৈঠকের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তাতেও গরহাজির থাকে তৃণমূল। কংগ্রেস রাহুলের নেতৃত্বে আদানি ‘ঘুষকাণ্ড’ নিয়ে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় ঝড় তুলতে চাইছে। কিন্তু দিনের পর দিন সংসদ অচল করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল। তৃণমূল সূত্রে আগেই জানা যায়, সংসদ অচল করে দেওয়ার কংগ্রেসের কৌশলে সায় নেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। আদানি-বিরোধী বিক্ষোভে দলের আপত্তি নেই। কিন্তু কংগ্রেস, আরও স্পষ্ট করে বললে রাহুল যে ভাবে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে সামনে রেখে বাকি বিরোধীদেরও তাতে শামিল হতে বলছেন, তাতে আপত্তি রয়েছে তৃণমূলের। রাজ্যের শাসকদলের তরফে প্রকাশ্যেই বলা হয়, একটিমাত্র বিষয় নিয়ে সংসদ বানচাল করার ঘোর বিরোধিতা করছে তারা। বরং রাজ্যের প্রতি ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ এবং দেশের অন্য সমস্যাগুলির বিষয়ে তারা সংসদে বেশি সরব হতে চায় বলে ইঙ্গিত দেয় তৃণমূল।
সব মিলিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল বা এসপির ‘দূরত্ব’ এই মুহূর্তে প্রকট। আপও দূরত্ব রেখেই চলছে। লোকসভায় সাংসদ সংখ্যার বিচারে বিরোধী জোটের বৃহত্তম দল কংগ্রেস (৯৯)। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল যথাক্রমে এসপি (৩৭) এবং তৃণমূল (২৯)। কিন্তু এই দুই দলের সঙ্গেই সংসদের ভিতরে ও বাইরে কৌশলগত প্রশ্নে কংগ্রেসের সম্পর্ক তেমন ‘মসৃণ’ নয়। দিল্লি এবং পঞ্জাবের শাসকদল আপ-এর সঙ্গেও কংগ্রেসের ‘দূরত্বের’ কথা সুবিদিত। গত লোকসভা ভোটে দূরত্ব ভুলে অবশ্য দুই দল দিল্লিতে জোট করে লড়েছিল। সাফল্য মেলেনি। খুব বড় কোনও অদলবদল না-হলে আগামী বছরের গোড়ায় দিল্লির বিধানসভা ভোটে আলাদাই লড়বে কংগ্রেস এবং অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল। ‘ইন্ডিয়া’য় যে-সমস্ত দলের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের সম্পর্ক ‘মসৃণ’, তাদের মধ্যে ডিএমকে (২২) ছাড়া কেউই সংসদীয় শক্তির বিচারে তেমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ নয়। আগামী দিনে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার ‘এক দেশ এক ভোট’ বা ওয়াকফ সংশোধনী বিল সংসদে পাশ করানোর চেষ্টা করলে বিরোধীরা নিদেনপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘লড়াই’ দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিরোধী সাংসদদের মধ্যেই।
তবে কি ‘ইন্ডিয়া’র দিন ঘনিয়ে এল? ভাঙন অবশ্যম্ভাবী? না কি এই ভাবেই কখনও দূরে থেকে, কখনও কাছাকাছি এসে কোনও রকমে টিকিয়ে রাখা হবে বিরোধী জোট? ‘কট্টর মমতা-বিরোধী’ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী যেমন এখনই ভাঙনের কোনও ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন না। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর এ বার তৃণমূলের কাছে হেরে গেলেও, বিগত লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা ছিলেন। তাঁর মতে, “আমি মনে করি না ‘ইন্ডিয়া’র ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে। ‘ইন্ডিয়া’ থাকবে।” তৃণমূল প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন, “ওদের আলাদা অ্যাজেন্ডা আছে। ওরা আদানিকে চটাতে চায় না। আসলে মোদী এবং দিদির মধ্যে সেতুবন্ধন করেন আদানি। আসলে দিদানি, মোদানি, আদানি সব এক হয়েছে।”