এয়োদশী দশার মহোত্সবে জগন্নাথ মন্দিরের দৈতাপতিরা। পুরীতে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
প্রভুর এয়োদশী দশার মহোত্সবের সকালে ঘন ঘন মোবাইল বেজেই চলেছে মুখ্য দৈতাপতির। ‘জয় জগন্নাথ’ বলে ফোন ধরা ও ছাড়ার ফাঁকে বেশির ভাগ সময়েই ঝরঝরে বাংলায় কথা সারছেন জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র।
‘‘এই তো আপনাদের কলকাতার এক বিচারপতি ফোন করেছিলেন! প্রভুর নবকলেবরের বিভ্রাটের ঘটনা নিয়ে সারা দেশ থেকেই ফোন পাচ্ছি!’’— হেসে বলছেন তিনি।
বাঙালি ভক্তদের সুবাদে কলকাতার অলিগলি অবধি মুখস্থ জগন্নাথদেবের প্রবীণ সেবায়েত জগন্নাথের। উত্তরের সাধন পান্ডে থেকে দক্ষিণ কলকাতার অরূপ বিশ্বাসের মতো নেতা-মন্ত্রী, কিংবা বাংলার অজস্র পরিচিত আমলাও তাঁর বিশেষ স্নেহধন্য।
শবর বংশোদ্ভূত জ্ঞাতিগুষ্টির যে শ’খানেক পুরোহিত বা সেবায়েতের হাতে মন্দিরের জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার নিত্য পরিচর্যা— এখন তাঁদের প্রধান এই জগন্নাথ সোয়াঁইন। লোকবিশ্বাস, এই দৈতাপতিরা সকলেই খোদ জগন্নাথের পরিবারের লোক। মন্দির থেকে আধ কিলোমিটার দূরে দৈতাপতি জগন্নাথের গোশালার উপরে ঝকঝকে অতিথিশালায় বসে কথা হচ্ছিল তাঁরই সঙ্গে।
দিন কয়েক আগে ব্রহ্ম পরিবর্তনের রাতে পুরনো বিগ্রহের ‘মৃত্যু’ হয়েছিল। গোপনে নতুন মূর্তি গড়া পর্যন্ত মন্দিরে এখন জগন্নাথদেবের প্রতিনিধিস্বরূপ দশাবতারের পুজো চলছে। আর স্বজন-বিয়োগের শোকে দৈতাপতিরা মু্ণ্ডিত মস্তকে অশৌচ পালন করছেন। আগামী রথযাত্রায় জগন্নাথের নবকলেবর-ধারণের আগে এ দিনের ‘ত্রয়োদশী দশা’র উত্সব যেন হিন্দুঘরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।
পুরনো মূর্তি ‘পাতালি’ করা বা মাটিতে সমাধিস্থ করার কথা বলতে বলতে এখনও ভ্রাতৃস্নেহে চোখ ছলছলিয়ে উঠছে প্রবীণ দৈতাপতির। ‘ব্রহ্ম পরিবর্তন’-এর গুপ্ত প্রক্রিয়ার চার সাক্ষীর অন্যতম দৈতাপতি জগন্নাথ। স্বয়ং জগন্নাথদেবের নতুন বিগ্রহে ব্রহ্মস্থাপনের গুরু দায়িত্ব তিনিই সম্পন্ন করেন। সেই ‘পবিত্র’ মুহূর্তে জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার অস্তিত্ব অনুভব করার কথা বলতে বলতে জগন্নাথ বলে ওঠেন, ‘‘এই দেখুন আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!’’
তবে, ব্রহ্ম পরিবর্তন-পর্বে বিভ্রাটের জেরে গোটা ওড়িশা জুড়ে এখন অজস্র কাঁটার খচখচ! প্রধান দৈতাপতি সরাসরি কারও নাম না-করেও বলছেন, ‘‘হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না। আমাদের দৈতাপতিদের মধ্যেও কারও কারও ব্রহ্ম দর্শন ও গুপ্ত প্রক্রিয়ায় উপস্থিত থাকার লোভেই যত বিপত্তি!’’
কী হয়েছিল ব্রহ্ম পরিবর্তনের রাতে?
অভিযোগ, ৭৬ বছরের বৃদ্ধ দৈতাপতি কাশীনাথ দাস মহাপাত্র ব্রহ্ম পরিবর্তনের দৃশ্য দেখার জেদ ধরেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে জয়কৃষ্ণ দাস মহাপাত্র। যিনি আবার বিজেডি-র যুব নেতাও বটে। সে-রাতে বলরামের বিগ্রহের ব্রহ্ম পরিবর্তন যিনি করেন, সেই দৈতাপতি হলধর দাস মহাপাত্র তাতে রুখে দাঁড়ান। গুপ্তপ্রক্রিয়ার মাঝপর্বে মন্দির ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হন তিনি। আপত্তি জানান দৈতাপতি জগন্নাথও। সাধারণত ব্রহ্ম পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি শেষ হতে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। কিন্তু এ বার কথা কাটাকাটিতে আরও কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়ে য়ায়। বৃদ্ধ দৈতাপতি কাশীনাথের ভাই রামকৃষ্ণ দাস মহাপাত্র। তিনি আবার দৈতাপতিদের সংগঠনের সভাপতি তথা প্রবীণ বিজেডি নেতা। দাদা ও ভাইপোর হয়ে সওয়াল করে দৈতাপতি রামকৃষ্ণের অভিযোগ, ‘‘কাশীনাথ অন্যায় কিছু দাবি করেননি। হলধর ও জগন্নাথ বিরোধিতা না-করলেই পারতেন।’’ কিন্তু জগন্নাথের বক্তব্য, ‘‘নিয়মের অন্যথা আমরা হতে দিতে পারি না।’’
ব্রহ্ম পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ত্রুটির জেরে দেরি হওয়ায় আম ওড়িশাবাসীর ভাবাবেগে কাঁটা বিঁধেছে বলে সরব রাজ্যে সরকার-বিরোধী কংগ্রেস ও বিজেপি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রসাদ হরি চন্দনের দাবি, ১৯৭৭ সালেও ব্রহ্ম পরিবর্তনের অনুষ্ঠানে ত্রুটি হয়েছিল। তাতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন বসায় সরকার। কংগ্রেসের আর্জি, হয় মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ইস্তফা দিন। না হলে ব্রহ্ম পরিবর্তনের রাতের ঘটনা নিয়ে বিচার-বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হোক। এই দাবিতে তাল ঠুকছে বিজেপি-ও। শুক্রবারের কংগ্রেসি বন্ধের কাঁটায় জেরবার শাসক দল বিজেডি। নবকলেবর অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত ক্যাবিনেট সদস্য মর্যাদার আধিকারিক তথা বিজেডি বিধায়ক মহেশ্বর মোহান্তি মুখে বলছেন, ‘‘জগন্নাথদেবকে নিয়ে রাজনীতি করা অনুচিত!’’ কিন্তু জনরোষের ভয়ে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই কাশীনাথ ও জয়কৃষ্ণ, এই দুই দৈতাপতিকে সাসপেন্ড করেছে।
ব্রহ্ম পরিবর্তনের সময়ে উপস্থিত থাকার জন্য কেন এক ব্যকুল হয়েছিলেন বৃদ্ধ দৈতাপতি কাশীনাথ?
মন্দির সূত্রের খবর, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথের অস্ত্র সুদর্শন (চক্র)-এর ব্রহ্ম পরিবর্তনের মূল কাজটা করেন বড়গ্রাহীরা। অন্য দৈতাপতিরা চার বিগ্রহের পরিচর্যায় চারটি দলে ভাগ হয়ে যান। তাঁরা হলেন, ভাগারী! এই ভাগারীরা ব্রহ্ম পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় থাকার সুযোগ পান না। তা ছাড়া, লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই গুপ্ত প্রক্রিয়া যিনি দেখেন, তাঁর জীবনের মেয়াদও নাকি ফুরিয়ে আসে! তাই দৈতাপতিরা অনেকে ব্রহ্ম পরিবর্তনের দায়িত্ব পালন করতেও পিছিয়ে আসেন। আবার প্রবীণ দৈতাপতিরা কেউ কেউ জীবনের উপান্তে এসে একবার ব্রহ্ম ‘দর্শন’-এর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। যেমন হয়েছিলেন কাশীনাথ।
এ দিন সকালেও মন্দিরে ভোগবিতরণের সময়ে ভক্তদের একাংশে উত্তেজনার আভাস মেলে। ব্রহ্ম-পরিবর্তন নিয়ে উষ্মার আবহে ত্রয়োদশীর অনুষ্ঠানেও কিছু বদল হয়েছে। কথা ছিল, লাখো ভক্ত মন্দিরের বাইরে রাস্তায় ভোগ গ্রহণ করবেন। দৈতাপতিরা বলছেন, আমাদের মন খারাপ, তাই মন্দির-চত্বরেই প্রসাদগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্দিরে ভোগের সেবায়েত বামুন ভীমসেন খুঁটিয়া আফশোস করলেন, গত নবকলেবরের ত্রয়োদশীতে আরও ভিড় হয়েছিল।
একটা বিষয়ে অবশ্য মতভেদের কাঁটা নেই। নবকলেবর ধারণ পর্যন্ত জগন্নাথের কাজ সুষ্ঠু ভাবেই মিটবে, এই বিশ্বাসে ভর করেই প্রশাসন-নেতা-সেবায়েত-কর্মকর্তা-ভক্তবৃন্দ— সবাই এ অনুষ্ঠানে মিশে গিয়েছেন।