চন্দন কাঠের পাশেই সারি সারি দেহ। রক্তচন্দন পাচারের অভিযোগে গুলি করে মারার পরে। ছবি: এএফপি।
চন্দন কাঠ পাচারকারী সন্দেহে অন্ধ্রের জঙ্গলে ২০ জনকে গুলি করে মারল সে রাজ্যের পুলিশ ও স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স। পুলিশের দাবি, জঙ্গলে তাদের উপরেই প্রথম হামলা চালায় রক্তচন্দন কাঠের চোরাচালানকারীরা। আত্মরক্ষা করতে পাল্টা গুলি চালাতে হয় পুলিশকে। এ ভাবে ২০ জনকে হত্যা করা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
বছর দশক আগে, ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর, তামিলনাড়ুর জঙ্গলে চন্দনদস্যু বীরাপ্পনকে মেরেছিল সে রাজ্যের টাস্ক ফোর্স। তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তখন পুলিশকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দু’দশকের চেষ্টা আজ সফল হয়েছে!’’ তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও কেরলের যৌথ বাহিনীর সেই সাফল্যের পিছনে ছিল কুড়ি বছরের লাগাতার অভিযান আর একশো কোটি টাকার বাজেট-বরাদ্দ। যে বীরাপ্পনের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছিল যৌথ বাহিনী, পুলিশের খাতায় তার করা খুনের সংখ্যা ১৮৪। এ ছাড়া, তার বিরুদ্ধে দু’শো হাতি মারা ও দশ হাজার টন চন্দন কাঠ পাচার করার অভিযোগও ছিল। কয়েকশো দস্যু নিয়ে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে রাজত্ব চালাত এই চন্দনদস্যু। হাতির দাঁত ও চন্দন কাঠ পাচার থেকে শুরু করে পুলিশ-হত্যা, হাই প্রোফাইল অপহরণ, কিছুই বাকি ছিল না বীরাপ্পন-জমানায়। তার ভাণ্ডারে ছিল দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র, যে সবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অনেক সময়ে পুলিশের পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠত না।
কিন্তু রক্তচন্দন পাচারকারী মনে করে আজ দু’টি পৃথক সংঘর্ষের ঘটনায় যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের হাতে কোনও স্বয়ংক্রিয় বন্দুক ছিল না। কাস্তে, কুড়ুল ও পাথর নিয়ে তারা পুলিশের উপর হামলা চালায়। এই অবস্থায় কেন পুলিশকে নিবির্চারে গুলি চালাতে হল, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ঘটনার কড়া নিন্দা করে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুকে চিঠি দিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ও পি পনিরসেলভম।
কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চন্দন কাঠের জঙ্গল। তার মধ্যে রক্তচন্দন (রেড স্যান্ডালউড বা রেড স্যান্ডার্স)-এর মূল ভাণ্ডার রায়লসীমার সেশচলম জঙ্গল। এ দেশে চোরাচালানকারীদের মধ্যে রক্তচন্দনের দাম টন পিছু ১৫-২০ লক্ষ টাকা। চিন বা জাপানে সেই এক টন রক্তচন্দনই বিক্রি হয় এক কোটি টাকায়। এই সেশচলমেই আজ পাচারকারীদের সঙ্গে দু’টি পৃথক সংঘর্ষ হয় অন্ধ্র পুলিশ ও রেড স্যান্ডার্স অ্যান্টি-স্মাগলিং টাস্ক ফোর্স (আরএসএএসটিএফ)-এর যৌথ বাহিনীর। তাদের সঙ্গে বন দফতরের কর্মীরাও ছিলেন বলে খবর।
রাজ্য পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, তিরুপতির কাছে সেশচলমের ঘন জঙ্গলে আজ অভিযানে গিয়ে প্রায় শ’দুয়েক চন্দন দস্যুর মুখোমুখি পড়ে যায় যৌথ বাহিনীর একটি দল। অন্ধ্র পুলিশ ছাড়াও ওই দলে ছিল রেড স্যান্ডার্স অ্যান্টি-স্মাগলিং টাস্ক ফোর্স (আরএসএএসটিএফ) এবং বন দফতরের কর্মীরা। শুরু হয় সংঘর্ষ। তাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়। অন্ধ্র পুলিশের দাবি, ওই সংঘর্ষের জেরে তাদেরও ছ’জন কর্মী আহত হয়েছেন।
ক্ষমতায় এলে চন্দন কাঠের পাচার বন্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবেন বলে নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। কিন্তু আজকের এই অভিযান নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ুর এবং রাজনৈতিক দলগুলি অন্ধ্র সরকারের সমালোচনা করেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী পনিরসেলভম ঘটনার নিন্দা করে চিঠি লিখেছেন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীকে। গোটা ঘটনার দ্রুত এবং যথাযথ তদন্তের দাবি জানানোর পাশাপাশি তিনি জানতে চেয়েছেন, এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দায় কার।
সরকারি ভাবে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, আত্মরক্ষা করতে পাল্টা গুলি চালানো ছাড়া পুলিশের উপায় ছিল না। নিহতদের মধ্যে ১২ জনই তামিল বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। তাঁরা সবাই বেআইনি ভাবে গাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি পুলিশের।
কিন্তু তামিলনাড়ুর নানা রাজনৈতিক দল, যেমন ডিএমকে, বিজেপি, পিএমকে এবং সিপিআই-এর অবশ্য দাবি, নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নিরীহ তামিল শ্রমিক। অন্ধ্র পুলিশ আত্মরক্ষার খাতিরে গুলি চালিয়েছিল এই তত্ত্বও মানতে নারাজ তারা। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের কোনও বিচারপতিকে দিয়ে গোটা ঘটনার তদন্ত করানোর দাবিও জানিয়েছে তারা। মঙ্গলবার ডিএমকে প্রধান করুণানিধি বলেন, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যসচিব এবং ডিজিপি-কে নোটিস পাঠিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালালে যদি ২০ জনের মৃত্যু হয়, তা হলে তাকে সমর্থন করা যায় না। পাচারকারী হলেও এ ভাবে হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে কমিশন।