‘রোরো’ স্টিমারের ছাদ থেকে রাতের পদ্মা। ছবি: দেবাশিস রায়।
ভাগ্যিস বাসটায় বিভ্রাট হয়েছিল। না হলে এমন মায়াবী দৃশ্যের সাক্ষী থাকা হতো না।
বাংলাদেশের ঘড়িতে তখন ভোর পৌনে পাঁচটা। গোয়ালন্দের ফেরি সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজার শেখ মহম্মদ নাসিম বোঝাচ্ছিলেন, এখানে পদ্মা-যমুনা মিলেছে। কিন্তু চলছে পাশাপাশি। ‘রোরো’ স্টিমারের মাথায় উঠেই দেখি, পশ্চিমে রাজবাড়ির দিকে শেষ রাতের জ্যোৎস্না আষ্টেপৃষ্ঠে গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছে পদ্মা। আর পুব দিকে মানিকগঞ্জে সবে দিনের আলো ফুটছে। সিঁদুরের রঙে মাখামাখি যমুনা যেন লাজে রাঙা কনে বৌটি!
কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরার এই বাস নবান্ন থেকে ঠিক সময়ে ছাড়লে ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যেতাম ঢাকায়। নদীর বুকে এই মুহূর্তটা দেখা হতো না।
কলকাতা থেকে আসার আগে বারবারই শুনেছি, আমরা ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সেই সন্ধিক্ষণে পৌঁছনোর রাস্তাটাও তো কম ঐতিহাসিক নয়! গত কালের বিভ্রাট খানিকটা সামাল দেওয়ার পরে বনগাঁর কাছে যশোহর রোডের উপর দিয়ে আসার সময়ে রাজ্যের পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘এই রাস্তা বাংলার অন্যতম প্রাচীন রাস্তা। দু’পাশের গাছের গুঁড়িগুলো দেখলে সহজেই ঠাহর করা যায়।’’ এই রাস্তা দিয়ে সিরাজ এসেছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করতে। দেশভাগের সময় হাজারে হাজারে মানুষ এই রাস্তা ধরেই আসতেন পদ্মার পশ্চিম পারে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীও গিয়েছিল এই যশোহর রোড ধরেই।
যশোহরের প্রবল পরাক্রমী রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন বারো ভুঁইঞাদের এক জন, ষোড়শ শতাব্দীতে যাঁরা মোগলদের বিরুদ্ধে লড়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। যাঁকে নিয়ে লেখা প্রতাপচন্দ্র ঘোষের উপন্যাস ‘গঙ্গাধীপ পরাজয়’ কাদম্বরীকে পড়ে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ। পরে তিনি নিজেও প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে ‘বউঠাকুরানির হাট’ উপন্যাস লেখেন। টেলিফোনে কলকাতার ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ দেবাশিস বসু বলছিলেন, ‘‘অদ্ভুত ভাবে দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এই প্রতাপাদিত্য ও তাঁর বংশধরদের। প্রতাপাদিত্য রোড, রাজা বসন্ত রায় রোড, প্রতাপাদিত্য প্লেস। বাদ যাননি প্রতাপাদিত্যের সেনাপতিও, সর্দার শঙ্কর রোড। আর এক রাজা সীতারাম, যার নামে বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখেছিলেন, তাঁর নামে রাস্তার নাম হয়েছে রাজা সীতারাম রোড। এ সবই হয়েছে ১৯৩১-৩২ সালে। ব্রিটিশদের হাতে যখন দক্ষিণ কলকাতার পত্তন হচ্ছে।’’ এক টুকরো যশোহর থেকে গিয়েছিল সেখানে।
শুধু কি রাজা-রাজড়ার নাম? রাত দু’টোয় মাগুরায় সার্কিট হাউসে নাছোড় জেলাশাসকের আতিথেয়তায় বরিশালের ইলিশ খেতে খেতে মনে পড়ল, একই ভাবে ২৪ পরগনার একটি পরগনার নাম ছিল মাগুরা। আলিপুর, গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর, চেতলা এবং বোড়ালকে নিয়ে ছিল ওই পরগনা। অবিভক্ত বাংলা জলের দেশ। মাগুর মাছের নামে জায়গার নাম সেখানে অকুলান নয়।
অতিথিকে বরণ করে নেওয়া যেন শিখতে হয় বাংলাদেশের কাছ থেকে। যবন হরিদাসের জন্মভূমি বেনাপোলে রাত সাড়ে এগারোটাতেও দাঁড়িয়েছিলেন হাজার দুয়েক মানুষ। রাজ্যের আবাসন ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস নিজের ছবি দেওয়া প্ল্যাকার্ড দেখে আপ্লুত। সীমান্ত পেরোতেই স্লোগান উঠল, ‘মন্ত্রী ভাইয়ের আগমন, লাল গোলাপ শুভেচ্ছা’। আমাদের স্বাগত জানাতে তখন অপেক্ষা করছেন যশোহরের দুই এমপি শেখ আসিলুদ্দিন এবং মহম্মদ মনিরুল ইসলাম। ছিলেন বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটনও। আর পুরো রাস্তা আমাদের সঙ্গে রইলেন বাংলাদেশ সরকারের সড়ক, পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব জাহাঙ্গির আলম।
বেনাপোল পেরিয়ে ঝিকরগাছা। পুরনো বাংলার গাছের নাম ঝিকর। আজ আর কেউই বলতে পারেন না, কোন গাছ সেটি। কিন্তু ঠাকুরপুকুর-বাঁকরাহাট রাস্তায় বড়কাছারি এলাকায় বিরাট একটি গাছের পুজো হয় দেখেছি। ওই এলাকার নামও ঝিকরবেড়িয়া। যশহর-মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে গোয়ালন্দ, ঝকঝকে রাস্তার দু’পাশে সারি দিয়ে শুধু মহীরূহের সারি। আর তার পরেই বিস্তীর্ণ খেত। গোয়ালন্দে দৌলতদিয়া ঘাট পেরিয়ে ও-পারে গিয়ে উঠলাম পাতুরিয়া ঘাটে, যা আদতে মানিকগঞ্জ জেলা। সেখান থেকে সোজা ঢাকা। ঢোকার মুখে দেখলাম সাভার-এর ভাষা শহিদ স্মরণস্থল। ততক্ষণে খবর এসে গিয়েছে, বিপর্যয় কাটিয়ে খারাপ হওয়া বাসটিও রওনা দিয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সেটা ঢাকা পৌঁছল। গত কাল নবান্নে বাস খারাপ হওয়ার পরে পরিবহণ দফতর আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি। যে বাসে চেপে আমরা ঢাকা পৌঁছলাম, নতুন বাসের সঙ্গে তৈরি রাখা হচ্ছে এই বাসটিকেও। কাল, শনিবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা রুটে নতুন বাসযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। তখন যাতে আর কোনও ঝামেলা না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।