ঠিক হয়েছিল হরিয়ানা থেকে রাজস্থানে যেতে গেলে আর ঘিঞ্জি দিল্লিতে ঢুকতে হবে না। নতুন এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হবে দিল্লিকে ঘিরে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তৈরি সড়কে টোল-এর হার কী হবে? কেন্দ্র বলছে, সাধারণ টোলের সওয়া এক গুণ বেশি শুল্ক চাপানো হোক। যোজনা কমিশন বলছে, না। অন্তত দেড় গুণ শুল্ক চাপানো হোক এই রাস্তায়। এই টানাপড়েনে গত চার বছর ধরে রাস্তা তৈরি দূরের কথা, এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ হয়নি।
সেই কবে ১৯৮৫ সালে যোজনা কমিশনের সদস্যদের ‘একদল জোকার’ বলে বিদ্রুপ করেছিলেন রাজীব গাঁধী। মুখ পাল্টালেও সেই ‘জোকার’-দের লোক হাসানো যে এখনও চলছে, দিল্লিকে ঘিরে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ আটকে থাকাই তার উদাহরণ। নরেন্দ্র মোদী সরকারের যোজনামন্ত্রী রাও ইন্দরজিৎ সিংহ নিজে হরিয়ানার সাংসদ। মন্ত্রী হয়েই তিনি চার বছরের পুরনো বিবাদ এক কথায় বন্ধ করে দেন। নিদান দেন, আগে জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তা তৈরি হোক। টোল কী হবে, তা পরে দেখা যাবে।
নরেন্দ্র মোদী আরও এক ধাপ এগিয়ে যোজনা কমিশনটাই তুলে দিয়েছেন। তাতে সব থেকে বেশি মন খারাপ এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদের। কারণ যোজনা কমিশনের চেয়ারে বসে পরামর্শ দেওয়ার দিন ফুরলো। এক সময় টেস্ট ক্রিকেটারদের মতোই জনপ্রিয় ছিলেন এই সব অর্থনীতিবিদ। প্রশান্ত মহলানবীশ থেকে সুখময় চক্রবর্তী যারাই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে।
সময় পাল্টেছে। সরকারি বিনিয়োগকে ছাপিয়ে গিয়েছে বেসরকারি লগ্নি। অর্থনীতিতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের থেকে এখন আন্তর্জাতিক পুঁজি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সরকারি ব্যয়বণ্টনের থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় সুদ-নীতি। স্বাভাবিক ভাবেই মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া নন, প্রচারমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পান রঘুরাম রাজন। বর্তমান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, এখন অর্থনীতির ছাত্ররাও তার খোঁজ রাখে না। অর্থনীতির পাঠক্রমেও সে সব পড়ানো হয় না। যোজনা কমিশনের এক উপদেষ্টাই ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, “যোজনা কমিশন এর পরেও আগের চেহারায় থেকে গেলে তার কাজ হত ৩০৩০ সালে আলুর দাম কত হবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করা।”
সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে সংসদ মার্গ ধরে হাঁটলে তিনটি বাড়ির পরেই যোজনা ভবন। কমিশন উঠে গেলে ১৯৫৪ সালে তৈরি যোজনা ভবনের নামটাও পাল্টে যাবে। তা সে যত ওজনদার ব্যক্তিই হোন, প্রথম থেকেই এই বাড়ির কর্তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার। রাজীব গাঁধী যে যোজনা কমিশনকে ‘জোকারের দল’ বলেছিলেন, তখন তার উপাধ্যক্ষ ছিলেন স্বয়ং মনমোহন সিংহ। কমিশনের সচিব সি জি সোমাইয়া পরে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, রাজীবের কথা শুনে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন মনমোহন। সোমাইয়া অনেক বুঝিয়ে তাঁকে ধরে রাখেন।
জওহরলাল নেহরু যখন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে যোজনা কমিশনে আনেন, সে সময়ও সব থেকে অখুশি হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি। মহলানবীশ যখন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করছেন, অর্থমন্ত্রী সে সময় ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী এক জন ‘সুপার ফিনান্স মিনিস্টার’ বসিয়েছেন!
গত দশ বছরের ইউপিএ-আমলে মন্টেক সিংহের জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে যোজনা কমিশনের সংঘাত আরও বেড়েছে। মনমোহনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিভিন্ন মন্ত্রকের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চেয়েছেন মন্টেক। তাতে হয় প্রকল্পের কাজ আটকে থেকেছে, অথবা যোজনা কমিশনকে পাত্তা না দিয়ে মন্ত্রকগুলি নিজেদের মতো কাজ করে গিয়েছে। যোজনা কমিশনের তৈরি দিস্তা দিস্তা নথি আলমারিতেই সাজানো থেকেছে।
এর সব থেকে বড় উদাহরণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের জন্য তৈরি চুক্তি বা ‘মডেল কনসেশন এগ্রিমেন্ট’-এর খসড়া। প্রায় গোটা পঞ্চাশেক এমন খসড়া ছাপিয়েছিলেন মন্টেক। দামি কাগজে, সুন্দর করে বাঁধানো সেই সব বই যোজনা কমিশনের আমলাদের ঘরে ঘরে সাজানো। কিন্তু একমাত্র বন্দর সংক্রান্ত চুক্তি বাদ দিলে কোনওটিতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদন মেলেনি। মন্টেক সেই সব চুক্তি মন্ত্রকগুলির উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ বা জাহাজ মন্ত্রক কিন্তু নিজেদের মতোই কাজ করে গিয়েছে।
বিভিন্ন শহরে মেট্রো রেল তৈরির ক্ষেত্রেও যোজনা কমিশনের নীতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরোন্নয়ন মন্ত্রক ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে হায়দরাবাদ, জয়পুরের মতো শহরে মেট্রো তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে। যোজনা কমিশন বলে দিয়েছে, নগরোন্নয়ন মন্ত্রক ও যোজনা কমিশনের সমান অংশীদারিত্ব থাকবে। কিন্তু যৌথ উদ্যোগে যে কোনও সংস্থা চালাতে গেলে কোনও এক জন লগ্নিকারীর অংশীদারিত্ব অন্তত ৫১ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। না হলে সংস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। হায়দরাবাদ, জয়পুরে মেট্রো রেলের কাজও একই সমস্যায় থমকে গিয়েছে।
বার বার কাজ আটকে দেওয়া মন্টেকের সেই যোজনা কমিশনই এ বার তুলে দিলেন নরেন্দ্র মোদী। কমিশনের এক প্রাক্তন সদস্যের কথায়, “আসলে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কটাই মুছে গিয়েছিল কমিশনের। যে যোজনা ভবনে ৩৫ লক্ষ টাকার শৌচাগার তৈরি হয়,সেই যোজনা ভবন থেকেই ঘোষণা হয় দেশে এক জন গরিব মানুষ মাত্র ২৮ টাকাতেই দিব্যি দিন গুজরান করতে পারেন।”