প্রদ্যুম্নকে স্কুলে ছেড়ে আসার সময় ওর বাবা কি ভাবতে পেরেছিলেন এমনটা হবে?—ফাইল চিত্র।
আমরা যে সময় স্কুলে পড়াশোনা করেছি, তখনও শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হয়নি। ‘কর্পোরাল পানিসমেন্ট’ কাকে বলে, জানতামও না। কিন্তু এটুকু মনে পড়ে, আমাদের স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে বাবা-মায়েরা পরম নিশ্চিন্ত থাকতেন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটু আধটু খুনসুটি-মারপিট হয় হোক, দুষ্টুমি করলে শিক্ষকরা একটু-আধটু বকুনি দিন বা চোখ রাঙান— তাঁদের ভরসা ছিল, ছেলেমেয়েরা স্কুলে মোটের উপর যথেষ্টই নিরাপদে থাকবে।
অথচ শিক্ষার অধিকার আইন সাত বছর পূর্ণ করে ফেলার পর, এই ২০১৭-য় পৌঁছে, সে ভরসাও বুঝি আর রইল না। উল্টে রাজধানী দিল্লির একেবারে নাগালের মধ্যে, গুরুগ্রামের অভিজাত স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রটির ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা অভিভাবকদের জন্য হাজির করল একরাশ ভয়, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা।
এই যে আমি সকালে স্কুলবাসে উঠিয়ে হাত নেড়ে টাটা করে দিয়ে এলাম ছেলেকে, সে আগামী কয়েক ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকবে তো? কিংবা এই যে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে এলাম স্কুলের দরজার সামনে, বিকেলে আনতে গিয়ে তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক দেখতে পাব তো? প্রদ্যুম্নকে স্কুলে ছেড়ে আসার সময় ওর বাবা কি ভাবতে পেরেছিলেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁকে পেতে হবে মর্মান্তিক এক ফোন— যা তাঁদের গোটা জীবনটাকেই এলোমেলো করে দেবে? প্রদ্যুম্নর মতো আরও অসংখ্য ছেলেমেয়ে যারা স্কুলে যায় রোজ, তাদের বাবা-মায়েরা এর পর কীসের ভরসায় তাদের পড়াশোনা করতে পাঠাবেন? বিদ্যালয়, যাকে আমরা এত দিন বিশ্বাস করে এসেছি পরিবারের বাইরে শিশুর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে— সেই বিশ্বাসটাই কি টাল খেয়ে গেল না এক নিমেষে?
আরও পড়ুন: উন্নয়নের বিজ্ঞাপনের আড়ালে ক্ষোভের সুর
অথচ এমন নয় যে, এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এই প্রথম হল আমাদের। গত প্রায় দু’দশক ধরে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে আপনারাও জানেন, শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি, এমনকী বিদ্যালয়ের পরিসরেও, আদৌ সুরক্ষিত নয়। সংবাদপত্রের পাতায় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এ ধরনের অসংখ্য খবর প্রায় প্রতি নিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। তথ্যের খাতিরে এ-ও জানানো যাক, এ-ধরনের ঘটনা যে ঘটে শুধু শহরাঞ্চলেই, বা কেবলমাত্র ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলেই, তেমনটাও নয়। সরকারি বা আধা-সরকারি স্কুল, কী শহরে, কী প্রত্যন্ত গ্রামে— সর্বত্রই শিশু-সুরক্ষার প্রশ্নটি মোটের উপর উপেক্ষিতই থাকে। কাগজে-কলমে নিয়মকানুন থাকলেও সে সব যথাযথ মেনে চলা প্রায়শই হয় না। সে কারণেই আমাদের শুনতে হয় মিড-ডে মিলের ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ে শিশুমৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা; প্রদ্যুম্নর মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে আসে, অকুস্থলে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও ঘটনার সময় সেটি নাকি কাজই করেনি!
অথচ এমন নয় যে, এ বিষয়ে আইনকানুন আদৌ কিছু নেই। স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় শিশু অধিকার কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনামা রয়েছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র-নিরাপত্তার বিষয়টি আঁটোসাটো করার জন্য কর্তৃপক্ষকে কী কী ব্যবস্থা নিতেই হবে, তার সুনির্দিষ্ট তালিকাও রয়েছে গোয়া, পঞ্জাব, চণ্ডীগড়, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের শিক্ষা দফতরের। কিন্তু নির্দেশিকা থাকা, আর তা পালন করা কি এক?
উল্লেখ করা দরকার, ‘গাইডলাইন্স ফর সেফটি অব চিলড্রেন ইন স্কুলস’ নামে ৪২ পাতার সবিস্তার নির্দেশিকা রয়েছে গুরুগ্রাম পুলিশেরও— সেই গুরুগ্রাম, যেখানে প্রদ্যুম্নর মৃত্যুর ঘটনা স্কুলে ছাত্র-নিরাপত্তার মস্ত বড় ফাঁকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। চাইল্ডলাইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন-এর এক সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের প্রায় ১২ লক্ষের বেশি বিদ্যালয়ের মাত্র ১০ শতাংশে রয়েছে নিজস্ব শিশু-সুরক্ষা বিধি। এ থেকেই বোঝা যায়, কী বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রোজ স্কুলে যাচ্ছে কার্যত কোনও নিরাপত্তার আশ্বাস ছাড়াই।
সরকারি তথ্যই বলছে, গত এক দশকে সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৫০০ শতাংশ। যদি সংখ্যার হিসেবে দেখি, ২০০৫-এ যেখানে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৭৫টি, ২০১৫-য় তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ১৭২-এ। ওই একই সময় কালে শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের হার (অর্থাৎ, প্রতি এক লক্ষ শিশু পিছু অপরাধের সংখ্যা) বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র ২০১৫ সালের তথ্য বলছে, শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের অর্ধেকেরও বেশি নথিভুক্ত হয়েছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লি— এই চার রাজ্যে। আর, শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের হারের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে দিল্লি ও হরিয়ানা। এই সূচকে জাতীয় গড় যেখানে ২১.১, দিল্লিতে তা ১৬৯.৪, আর হরিয়ানায় ৩৫.১। এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হল, এনসিআরবি-র ওই একই বছরের তথ্য-অনুসারে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-নিগ্রহ, ধর্ষণ, অপহরণ প্রভৃতি পকসো আইনের আওতাধীন অপরাধের প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ও অপরাধীরা ছিল শিশুদের পূর্বপরিচিত। যার সহজ অর্থ দাঁড়ায়, যাদের হাতে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাঁদের একটা বড় অংশই শিশু-সুরক্ষার প্রতি সম্পূর্ণ অসচেতন, অনির্ভরযোগ্য, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বা অপরাধমনস্কও।
আরও পড়ুন: এ বার তৈরি হচ্ছে মুসলিম ভুয়ো গুরুদের তালিকা
প্রশ্ন হল, কী ভাবে, কোন পথে বিদ্যালয় পরিসরে শিশুর সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা যায়। একটু আগেই যে কথা বলছিলাম, কাগজে-কলমে নির্দেশিকার অভাব না-থাকলেও ভয়ঙ্কর ঘাটতি রয়েছে সেই নির্দেশিকা মেনে চলার সদিচ্ছায়, এবং যথাযথ নজরদারির। এ ক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, সে-বিষয়েও সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু বিদ্যালয়গুলি শিশু-সুরক্ষা নির্দেশিকা মেনে চলছে কিনা, তার জন্যও তো চাই নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির প্রক্রিয়া। এবং এ বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শিক্ষা দফতরকেই। তার জন্য দরকার নির্দিষ্ট দিশানির্দেশ, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও তার সুষ্টু রূপায়ণ। তা ছাড়াও, শিক্ষার অধিকার আইনে যে ‘স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গড়ে তোলার কথা আছে, সেখানে অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্বের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক রাজ্যেই এখনও স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া বিশ বাঁও জলে।
বিদ্যালয় পরিসরে, এবং তার বাইরেও শিশুদের ১০০ শতাংশ সুরক্ষা নিশ্চিত করাকে যদি একটি অবশ্যকর্তব্য (আইনের ভাষায়, ‘নন-নেগোশিয়েব্ল’) হিসেবে দেখতে চাই, তা হলে এ ছাড়া গতি নেই। আর, হ্যাঁ, এর জন্য অবশ্যই রাখতে হবে যথাযথ অর্থবরাদ্দও। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি যেখানে শিশু, সেখানে মোট বাজেটের মাত্র ০.০৩ শতাংশ শিশু-সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ করে আমরা কি এ বিষয়ে যথেষ্ট সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছি?
শেষে আর একটি কথা। গুরুগ্রামের সাম্প্রতিকতম ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রতি যদি অভিভাবকদের মনে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়ে থাকে, তা আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা কিন্তু সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব। যদি আমরা নীতিগত ভাবে মেনে নিই যে, যে কোনও বিদ্যালয়ই ব্যাপকতর অর্থে এক একটি শিশুকল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান, তা হলে অবিলম্বে, এবং যে কোনও মূল্যে, সেই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আজ এবং এখনই।
(লেখক সর্বভারতীয় শিশু-অধিকার সংস্থা ‘ক্রাই— চাইল্ড রাইট্স অ্যান্ড ইউ’-এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখার বরিষ্ঠ আধিকারিক)