সেনা অভিযানের পরে কড়া পাহারা শ্রীনগরের রাস্তায়। ছবি: রয়টার্স।
শুধু কথাই হচ্ছিল এত দিন। কিন্তু তাতে যে আদৌ কোনও লাভ হবে না, সেটা আন্দাজ করে এ বারে ‘কাজ’ শুরু করে দিল ভারতীয় সেনা। বুধবার গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে আচমকা অভিযান চালিয়ে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে ফিরে এল নিজেদের ব্যারাকে। সেনার পরিভাষায় ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। শুধু এটুকু নয়, এই প্রথম নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে সেনা অভিযানের কথা বুক ঠুকে ঘোষণাও করে দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। পাকিস্তানকেও সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হল সে কথা।
সেনাবাহিনীর দাবি, নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা জঙ্গিদের একাধিক ঘাঁটিতে বুধবার গভীর রাতে অভিযান চালানো হয়। রাত সাড়ে ১২টা থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটে পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে আসেন সেনা কম্যান্ডোরা। সেনার স্পেশ্যাল ফোর্সের প্যারা কম্যান্ডোদের এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এ অন্তত ৩৮ জন জঙ্গি এবং দুই পাক সেনা জওয়ান নিহত হয়েছে। ভারতীয় জওয়ানদের কেউ হতাহত হননি বলেই সেনার দাবি।
উরির সেনা ছাউনিতে পাকিস্তানের মদতেপুষ্ট জঙ্গিদের হামলার পরে নয়াদিল্লির তরফে একাধিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ করা হয়েছে। পাক সরকারকে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদ সে সব নিয়ে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দিলেও এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, সেটা আন্দাজই করতে পারেনি। তাই সেনা অভিযান নিয়ে ভারতের ঘোষণার পরে হতচকিত হয়ে পড়ে তারা। একবার ‘ভারতের হামলার’ নিন্দা করে বিবৃতি দিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ‘বদলা’র হুমকি দিয়েছে। আবার তাতে নিজেদেরই দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ছে আন্দাজ করে শেষ পর্যন্ত ‘এ ধরনের কোনও সেনা অভিযান হয়নি’ বলে বিবৃতিও দিয়ে বসেছে তারা!
বুধবার রাতে এই অভিযান যখন চলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে রাত জেগে তার উপর নজর রেখেছিলেন বলে সরকারি সূত্রের দাবি। ভারতীয় সেনা অভিযান সেরে ঘাঁটিতে ফেরার পরে সকালে বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি। তার পরেই উরির সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার জবাব হিসেবে এই সেনা অভিযানকে তুলে ধরে প্রচারে নেমে পড়ে মোদী সরকার। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ থেকে প্রাক্তন সেনা অফিসার, এমনকী ভারতীয় বণিকসভা ও একাধিক কর্পোরেট সংস্থার কর্ণধারও সেনার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন সেনা অফিসারদের অনেকেই বলছেন, এর আগেও নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত এলাকায় জঙ্গি ঘাঁটিতে হামলা করেছে ভারতীয় সেনা। তিন বছর আগে পাক সেনা ভারতীয় সেনার ল্যান্সনায়েক হেমরাজের মাথা কেটে নেওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক সেনাকে জবাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কখনওই তা স্বীকার করা হয়নি। মুম্বইয়ে ২৬/১১-র হামলার পর তৎকালীন ভারতীয় বায়ুসেনা প্রধান ফালি হোমি মেজর এই ধরনের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর প্রস্তাব দিলেও মনমোহন সরকার তাতে সম্মতি দেয়নি। এ দিন প্রাক্তন সেনাপ্রধান বিক্রম সিংহ বলেন, ‘‘এ বার ফারাক হল, মোদী সরকার সেই রাজনৈতিক সাহস দেখাল। তার কথা স্বীকারও করল। এই প্রথম সরকারি খাতায়-কলমে নিয়ন্ত্রণরেখার উল্টো দিকে সেনা অভিযান হল।’’ অভিযান শেষে ভারতের ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস) রণবীর সিংহ নিজেই পাকিস্তানের ডিজিএমও-কে ফোন করে খবরটি দিয়েছেন।
দিনভর নানা রকম বিবৃতি ও মন্তব্য করার পরে বিভ্রান্ত পাক সেনা দিনের শেষে দাবি করেছে, এই ধরনের কোনও ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হয়নি। তাদের দাবি, ভারতীয় সেনা নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কেল, তাতপানি, লিপা, ভিমবের-সহ পাঁচটি সেক্টরে সংঘর্ষবিরতি ভেঙে গুলি চালিয়েছে। তাতে দুই পাক জওয়ান নিহত হয়েছেন। আর ভারতীয় সেনা-র যুক্তি, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ যে করা হয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে অভিযানের ছবি রয়েছে। ছবি তোলা হল কী ভাবে? সেনা সূত্রের দাবি, ড্রোন ব্যবহার করে গোটা অপারেশনের ছবি তুলে রাখা হয়েছে। সেনা যখন প্রয়োজন মনে করবে, তখনই তা প্রকাশ করবে।
সেনা সূত্রের খবর, কম্যান্ডোদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ‘বডি’ বা ‘বাডি’, কাউকেই ফেলে আসা চলবে না। অর্থাৎ, অভিযানে কেউ আহত হলে বা মারা গেলে, তাঁদের সঙ্গে করেই ফিরিয়ে আসতে হবে। সেনার একটি সূত্রের খবর, বুধবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ অভিযান শুরু হয়। এমআই-১৭ হেলিকপ্টারে করে স্পেশ্যাল ফোর্সের ১০০-১৫০ কম্যান্ডোকে নামিয়ে দেওয়া হয় নিয়ন্ত্ররেখার ওপারে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে। তারাই ছোট দলে ভাগ হয়ে, তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ভিতরে ঢুকে জঙ্গিদের সাতটি লঞ্চ-প্যাডে অভিযান চালায়। মছিলের উল্টো দিকে কেল, মেন্ধারের উল্টো দিকে তাতপানি এবং নওগামের উল্টো দিকে লিপা-য় মূলত অভিযান চলে। একাধিক জঙ্গি, তাদের হ্যান্ডলার, গাইড মিলিয়ে অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছে বলে সেনা সূত্রের দাবি। মার্কিন গোয়েন্দাদের থেকেও প্রযুক্তিগত সাহায্য নেওয়া হয়েছে বলে সেনার একটি সূত্রের দাবি।
প্রশ্ন হল, পাক সেনা কিছুই টের পেল না কেন? সেনা সূত্রের দাবি, পাকিস্তান এমন অভিযানের জন্য মোটেই তৈরি ছিল না। পাক সেনাকে বিভ্রান্ত করতে এই অভিযানের সময় উরি থেকে মর্টার ও গোলাগুলি ছোড়া হয়। ভারতীয় কম্যান্ডোরা যখন অভিযান শেষ করে ফিরছেন, সেই সময় গোলমাল আঁচ করে পাক সেনা। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বুঝতে না পেরে তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। পাল্টা জবাব দেয় ভারতও।
সাংবাদিক বৈঠকে ডিজিএমও রণবীর সিংহ। ছবি: পিটিআই।
জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালালেও ভারত যে পুরোপুরি যুদ্ধ চাইছে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে মোদী সরকার। ডিজিএমও-র বিবৃতিতে সুকৌশলে তা বুঝিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, জঙ্গিদের নিকেশ করার জন্য অভিযান হয়েছি। সেই অভিযান শেষ। তা চালিয়ে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে পাকিস্তানের দিক থেকে কোনও প্রত্যাঘাত এলে তার জন্য সেনা তৈরি। ভারত শান্তি চায় ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে জঙ্গিদের হামলা করার ছাড়পত্র দেওয়া যায় না। প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান ফালি হোমি মেজর বলেন, ‘‘এই ধরনের অভিযান আগেই দরকার ছিল। এই ধরনের অভিযানের প্রত্যাঘাত হলে কী হবে, সেই অঙ্ক কষে নিয়েই অভিযান হয়।’’ এক সময় পাকিস্তানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন জি পার্থসারথি। তাঁর মতে, ‘‘খুব বেশি হলে লস্কর জঙ্গিরা ভারতে হামলা চালাতে পারে।’’
বিজেপি নেতৃত্বের যুক্তি, নওয়াজের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন মোদী। কিন্তু পাকিস্তান তা মানেনি। তা ছাড়া, উরির ঘটনার পরে দেশের মাটিতে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাল দিতে এই ধরনের কড়া বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। মোদী বারবারই বলেছেন, উরির হামলাকারীরা ছাড় পাবে না। যুদ্ধ না করলেও উরির পাল্টা হিসেবে এই ধরনের জঙ্গি দমন অপারেশনের কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, সামরিক অভিযানের পর তা স্বীকার করা হবে কি না, সেটাই ঠিক করার দরকার ছিল। পার্থসারথি এ দিন বলেন, ‘‘ঠিক যা যা করার দরকার ছিল, তা-ই করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু নিয়ন্ত্রণরেখাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। জঙ্গিদের নিকেশ করার জন্য আন্তর্জাতিক সীমান্ত লঙ্ঘন করিনি। এই পাকিস্তানেই লুকিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে নিকেশ করার জন্য আমেরিকা কিন্তু পাক সীমান্ত পেরিয়েই অভিযান চালিয়েছিল।’’
বুধবার রাতের অভিযানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি সূত্রে বলা হয়েছে, উরি হামলার পরে কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহলে একঘরে করার কাজ চলছিলই। সেই সূত্রে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে পাকিস্তানকে নিশানা করা থেকে ইসলামাবাদের সার্ক সম্মেলন বয়কট— এ সব কাজ প্রায় শেষ। সে সব মিটতেই শুরু জঙ্গি নিকেশ অভিযান। ডিজিএমও অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘নিয়ন্ত্রণরেখার উল্টো দিক দিয়ে ঢুকে জম্মু-কাশ্মীর এবং দেশের অন্যান্য শহরে হামলার জন্য কয়েক জন সন্ত্রাসবাদী জড়ো হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পরেই জঙ্গি অনুপ্রবেশ রুখতে জঙ্গিদের একাধিক লঞ্চ প্যাডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা হয়েছে।’’
কিন্তু পাকিস্তান কি এর পরেও শিক্ষা নেবে? প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনমোহন বাহাদুর বলেন, ‘‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে সরাসরি যুদ্ধবিমান থেকেও হামলা চালানো যায়। কিন্তু তা হলে এর মাত্রা অনেকখানি বেড়ে যেত। কিন্তু এই অভিযানেও পাকিস্তানের কাছে বার্তা পৌঁছেছে যে, ভারত পাল্টা জবাব দিলে কী করতে পারে।’’