দু’পক্ষের মুখেই আমজনতা!
এক পক্ষ বলছেন, জনতার দুর্ভোগের কথা। অন্য পক্ষ জনতার সমর্থনের কথা।
এক পক্ষের কাছে জনতাই অস্ত্র। অপর পক্ষের কাছে ঢাল!
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তামাম বিরোধী শিবিরের সাম্প্রতিক তরজার কেন্দ্রে যাঁরা, সেই আমজনতা এখনও পর্যন্ত কার্যত নীরবে মেনে নিয়েছেন নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। যিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই মোদী এক লাফে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছেন। এখন আর তাঁর পিছু হটার পথ নেই। এই অবস্থায় বিরোধীরা যাঁদের দুর্ভোগকে অস্ত্র করে তাঁকে লাগাতার নিশানা করছেন, তাঁদের পাশে পেতে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী দিলেন কৃতজ্ঞতার বার্তা। কষ্ট সহ্য করেও নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য জনতাকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশিই আক্রমণ করলেন বিরোধীদের। নোট বাতিল নিয়ে আপত্তি তোলায় বিরোধীদের সকলকে কার্যত কালো টাকার কারবারি বলে তোপ দাগলেন তিনি।
নোট বাতিলের জেরে মানুষের ভোগান্তির অভিযোগ তুলে বিরোধীরা বারবার সংসদ অচল করে দিচ্ছেন। রাহুল গাঁধী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অরবিন্দ কেজরীবাল— সকলেই হাত মিলিয়ে পথে নেমেছেন। সেই প্রতিবাদে সামিল বামেরাও। এমনকী মোদীর দলের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী শিবসেনার মতো কিছু দলও সরব। এই পরিস্থিতিতেও মোদী পিছু না হটে আরও কড়া ব্যবস্থারই ইঙ্গিত দিচ্ছেন নিত্যদিন। উল্টে কালো টাকা জমা পড়লে তার উপরে বিপুল কর বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি বিরোধী তির সামাল দিতে এ বার ঢাল করলেন পাল্টা আক্রমণকে। নোট বাতিল নিয়ে রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীকে হাজির হয়ে জবাব দিতে হবে, বিরোধীরা এই দাবি তুললেও মোদী তা করেননি। গত কালই রাজ্যসভায় মুখ খুলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা অর্থনীতির শিক্ষক মনমোহন সিংহ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের যে সব ভুলত্রুটি তুলে ধরেছিলেন, তারও জবাব দেননি। তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও মনমোহন সিংহের তোলা একটি অভিযোগও পাল্টা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেননি। এই অবস্থায় আজ মোদী সংবিধান দিবস উপলক্ষে সংসদ চত্বরে এক অনুষ্ঠানে এসে বিরোধীদের নিশানা করে বললেন, ‘‘যাঁরা নোট বাতিলের সমালোচনা করছেন, তাঁদের আসল সমস্যা হল, নিজেরা গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাননি!’’ মোদীর বক্তব্য, ‘গুছিয়ে নেওয়ার জন্য’ ৭২ ঘণ্টা সময় হাতে পেলে বিরোধীরা প্রশংসাই করতেন!
নোট বাতিল নিয়ে ভিতরে ভিতরে অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেও বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে অন্তত একজোট হয়ে মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। মোদী নিজেও বুঝতে পারছেন, তাঁর পক্ষে আর বাঘের পিঠ থেকে নামা সম্ভব নয়। তাই ক্রমশ আগ্রাসী হচ্ছেন তিনি। আর সেটা করতে গিয়েই আজ বিরোধীদের সকলকে কালো টাকার কারবারি বলে দেগে দিলেন। দিল্লিতে বসে বিরোধীদের এ ভাবে নিশানা করার কিছু পরেই পঞ্জাবে গিয়ে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার জন্য সাধারণ মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘‘হয়রানি সহ্য করতে হলেও মানুষ যে আমার পাশে রয়েছেন, তার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই।’’ হয়রানি কমাতে মোবাইলেই লেনদেনের পরামর্শ দিয়ে জনতাকে মোদী বলেন, ‘‘হাতের মোবাইলটাকেই ব্যাঙ্ক বলে ভাবুন।’’
বিরোধীদের সকলকে কালো টাকার কারবারি বলার প্রতিক্রিয়া যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। রাজ্যসভায় গুলাম নবি আজাদ, মায়াবতী, ডেরেক ও’ব্রায়েন, শরদ যাদবরা এক সুরে দাবি তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর মন্তব্যের জন্য রাজ্যসভায় এসে ক্ষমা চাইতে হবে। বিরোধীরা এক সুরে বলছেন, বাইরে এত কথা বলে বেড়ানো মোদী সংসদ থেকে পালাচ্ছেন কেন? রাহুল গাঁধীর তীব্র কটাক্ষ, ‘‘তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন!
সংসদে এসে এই সব আবেগ দেখান না! কীসের ভয় ওঁর? সংসদে মুখ খুললেই সব স্পষ্ট হয়ে যায়!’’ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাজে রাজনীতিক ও জঘন্য প্রশাসক! সমানে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছেন! মানুষ যখন ভুগছে, উনি তখন আয়েস করছেন!’’
বিরোধীদের অভিযোগ, কৌশলগত ভাবেই রাজ্যসভার বিতর্ক এড়িয়ে যাচ্ছেন মোদী। কারণ সেখানে তাঁকে নোট বাতিলের পক্ষে অর্থনীতির যুক্তি পেশ করতে হবে। কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল বলেন, ‘‘মাঠেঘাটে মানুষকে উল্টোপাল্টা বোঝানো এক বিষয়। রাজ্যসভায় এলে তাঁকে সব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। গত কাল মনমোহন সিংহ যে সব সমালোচনা করেছেন, অর্থনীতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তারও জবাব দিতে হবে।’’ বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, মোদীকে চাপে রাখতে তাঁর আজকের মন্তব্যের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং বিতর্কের সময় আগাগোড়া হাজিরা, এই দুই দাবিতেই অনড় থাকবেন সকলে। সোমবার মোদী বিতর্কের সময় হাজির হয়ে বিতর্কে অংশ নিতে চাইলেও তাঁকে আগে ক্ষমা চাইতে বলা হবে। না হলে সংসদ চলতে দেওয়া হবে না। লোকসভাতেও সব কাজ মুলতুবি করে আলোচনার দাবি তোলা হবে।
আজ ভাটিন্ডায় এইমস-এর নতুন হাসপাতালের শিলান্যাস করেন মোদী। সেখানে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পক্ষে যে ভাবে মুখ খুলেছেন, তার পরে রাজনীতিকরা বলছেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে স্বঘোষিত যুদ্ধে মোদী এখন খোলাখুলিই গরিব ও বড়লোকের মেরুকরণ করতে চাইছেন। তিনি যেন ‘আমিরি হঠাও’-এর ডাক দিয়েছেন! তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেই কালো টাকার কারবারি বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। আর আমজনতার পাশে থাকার বার্তা দিতে বলছেন, ‘‘মধ্যবিত্ত যাতে শোষিত না হয় এবং গরিব মানুষ তার ন্যায্য পাওনা পায়, তার জন্য আমি সম্ভাব্য সব কিছু করছি।’’