পি চিদম্বরম। ফাইল চিত্র।
উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় যে ভাবে সংবিধান সংশোধনে সংসদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কথা বলছেন, তাতে সংবিধানের পক্ষে বিপদ দেখছে বিরোধী শিবির। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের প্রশ্ন, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে কোনও সরকার যদি সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসনব্যবস্থা চালু করে, তাকে কি বৈধ বলা যাবে? সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নেয়, তা-ও কি সংবিধান-সম্মত বলা যাবে?
উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ধনখড় মোদী সরকারের জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছিলেন বুধবার। তাঁর যুক্তি ছিল, সুপ্রিম কোর্ট ওই আইন সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’-র বিরুদ্ধে বলে খারিজ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭৩ সালে প্রথম যে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’-র কথা বলেছিল, সেই মামলার রায়কেও ‘খারাপ নজির’ বলে তকমা দেন তিনি। ধনখড়ের যুক্তি ছিল, সংসদই সর্বোচ্চ। সংসদের ইচ্ছে মতো সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা থাকা উচিত। সেটাই গণতন্ত্রের জীবনরেখা। চিদম্বরমের মতে, ‘‘এই মতামত শুনে প্রতিটি সংবিধান-প্রেমী নাগরিকের ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত।’’
বিরোধী শিবির তথা সংবিধান বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ধনখড় বাস্তবে ইচ্ছে মতো সংবিধান সংশোধনের পক্ষে সওয়াল করছেন। তিনি যা বলছেন, তার অর্থ হল, সংসদে কোনও দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এবং তারা বেশির ভাগ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলে, তারা সংবিধানের মূল ভাবনাই বদলে দিতে পারে। চিদম্বরমের মতে, ‘‘সংসদ সর্বোচ্চ বলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ভুল বলছেন। আসলে সংবিধান সর্বোচ্চ।’’ একই যুক্তি কেন্দ্রের প্রাক্তন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইনের বিরুদ্ধে অন্যতম মামলাকারী ছিলাম। সুপ্রিম কোর্ট ওই আইন খারিজ করে দিয়েছে। কারণ, সংসদ সংবিধান বিরোধী আইন তৈরি করতে পারে না। সংসদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই। সংবিধানের ২৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রও তা জানে। সাংবিধানিক পদে বসে সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলা যথাযথ নয়। দুর্ভাগ্যজনকও।’’
আইনজ্ঞেরা বলছেন, সংসদ না সুপ্রিম কোর্ট, কে সর্বোচ্চ— সেই নিয়ে বিতর্কে গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ইন্দিরা গান্ধী সরকার এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এর পরে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ১৩ জন বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয়, সংবিধানের মূল কাঠামোয় হাত দেওয়া চলবে না।
চিদম্বরমের বক্তব্য, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের ভিত্তিতে যাতে কেউ আঘাত করতে না পারে, তার জন্যই সংবিধানের মূল কাঠামোর তত্ত্বের অবতারণা। সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেওয়ার পরে মোদী সরকার চাইলে নতুন আইন আনতে পারত। ওই আইন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে বলে সংবিধানের মূল কাঠামোর তত্ত্ব ভুল হয়ে যায়নি। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘বিজেপির অরুণ জেটলির মতো আইনজীবীও কেশবানন্দ ভারতী মামলার রায়কে মাইলফলক বলে মনে করতেন। ভিন্ন মত থাকতেই পারে। কিন্তু উপরাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন।’’