National Butterfly

‘জাতীয় প্রজাপতি’ বাছতে অনলাইনে ভোট দেশ জুড়ে

বিভিন্ন রাজ্যের প্রজাপতি পর্যবেক্ষক এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেইন কনসর্টিয়াম’-এর উদ্য়োগে অনলাইন ভোটপর্ব চলবে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত।

Advertisement

সায়ন ত্রিপাঠী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:২৯
Share:

কৃষ্ণা পিকক। ছবি: ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেইন কনসর্টিয়াম সূত্রে পাওয়া

অনলাইনে জমজমাট ভোট। তবে টিভি-র কোনও ‘রিয়্যালিটি শো’-এর সেরা বাছাই করতে নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছে ‘জাতীয় প্রজাপতি’ মনোনয়নের আবেদন জানাতে। প্রজাপতির প্রজাতি নির্বাচন করতে। ‘জাতীয় প্রজাপতি’ নির্বাচনের এই উদ্যোগ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের প্রজাপতি পর্যবেক্ষক ও গবেষকদের যৌথ মঞ্চ ‘ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেইন কনসর্টিয়াম’-এর। তাদের প্রচেষ্টায় দেশের ১,৩০০-র বেশি প্রজাপতির মধ্যে ৭টিকে বেছে নিয়ে চলছে ভোটপর্ব। অংশ নিতে পারছে আমজনতাও।

Advertisement

সংগঠনের ৫০ সদস্যের জাতীয় পরিচালন সমিতিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পতঙ্গবিদ থেকে শুরু করে জাতীয় ও রাজ্যস্তরের বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্যেরা রয়েছেন। ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি (বিএনএইচএস)’র অধিকর্তা আইজ্যাক কেহিমকার, বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর প্রজাপতি বিজ্ঞানী ক্রুষ্ণামেঘ কুন্তে, ‘মহারাষ্ট্র বায়োডাইভার্সিটি বোর্ড’-এর প্রধান বিলাস বরদেকর, আমেরিকার ফ্লোরিডার ‘মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’র প্রজাপতি বিজ্ঞানী বিজয় বার্ভে, মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন প্রধান মুখ্য-বনপাল অনিল নাগরের মতো পরিচিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষক রয়েছেন সেই তালিকায়।

কনসর্টিয়ামের সদস্য অর্জন বসু রায় জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতির আগে থেকেই বিভিন্ন রাজ্যের প্রজাপতিপ্রেমী এবং বিশেষজ্ঞদের ‘জাতীয় প্রজাপতি’ নির্বাচনের মাপকাঠি তৈরির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। লকডাউন পরিস্থিতিতেও ওয়েবিনার ও ভার্চুয়াল সভায় চলে ঝাড়াই-বাছাই পর্ব। প্রাথমিক ভাবে ৫১টি প্রজাতিকে বেছে নিয়েছিল সংগঠনের জাতীয় পরিচালন সমিতি। অর্জন বলেন, ‘‘এর পর কিছু মাপকাঠির ভিত্তিতে ‘ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেইন কনসর্টিয়াম’-এর সাধারণ সদস্যদের ভোটাভুটিতে বেছে নেওয়া হয়েছে ৭টি প্রজাতিকে।

Advertisement

অরেঞ্জ ওকলিফ

১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’।’’ অনলাইন গুগল ফর্মের মাধ্যমে ভোট চলবে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত। বড়দের পাশাপাশি এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ছোটদের অংশগ্রহণও বিশেষ ভাবে কাম্য বলে জানাচ্ছেন, কনসর্টিয়ামে যুক্ত বিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মীরা।

ভোটের জন্য গুগল ফর্মের লিংক: https://forms.gle/u7WgCuuGSYC9AgLG6

‘ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেইন কনসর্টিয়াম’-এর আরেক সদস্য যুধাজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এত দিন সংরক্ষণের ঝোঁকটা বেশি করে ছিল বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডারের মতো বৃহৎ প্রাণীদের ক্ষেত্রে। কিন্তু চোখের প্রায় আড়ালে থেকে যে প্রাণীরা বাস্তুতন্ত্রের কাঠামো ধরে রেখেছে, এবার তাদের দিকে এবার তাকানো জরুরি। তারই প্রাথমিক ধাপ ‘জাতীয় প্রজাপতি’ নির্বাচন। কারণ, প্রজাপতি এক হিসেবে গোটা পতঙ্গকুলের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।’’

ফাইভ-বার সোর্ডটেল

ভারতের জাতীয় পশু ও জাতীয় পাখি চিহ্নিত করা হলেও কোনও প্রজাপতিকে এখনও ‘জাতীয়’ অভিধা দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়নি। যদিও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এমনকি, প্রতিবেশী ভুটানও ইতিমধ্যে তাদের জাতীয় প্রজাপতি বেছে নিয়েছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের সরকারও ‘রাজ্য প্রজাপতি’ চিহ্নিত করার কাজ সেরে ফেলেছে। ‘জাতীয় প্রজাপতি’র তকমা ঘোষিত হলে আমজনতার মনে প্রজাপতির পাশাপাশি সামগ্রিক ভাবে পতঙ্গজগৎ সম্পর্কেও সচেতনতা তৈরি হবে বলে উদ্যোক্তাদের দাবি।

আরও পড়ুন: সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে কাঁকড়া! এ ভিডিয়ো দেখেও যেন বিশ্বাস হয় না

অসমের প্রজাপতি বিশারদ মনসুনজ্যোতি গগৈ জানাচ্ছেন, ‘জাতীয় প্রজাপতি’ নির্বাচনের জন্য যে মাপকাঠি তৈরি হয়েছে, সেগুলি হল—

১. সাংস্কৃতিক, বাস্তুতান্ত্রিক এবং সংরক্ষণ মানদণ্ড অনুযায়ী প্রজাপতিটি গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে।

২. প্রজাপতিটি যেন ‘দর্শনধারী’ হয়, মনে সম্ভ্রম জাগায়।

৩. প্রজাপতিটির জীবনচক্রে কিছু কৌতূহলজনক বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন।

ইন্ডিয়ান নবাব

৪. প্রজাপতিটিকে যেন সহজে চেনা যায়, দেখা যায় এবং মনে রাখা যায়। তবে যেন বেশি ‘সুলভ’ না হয়।

৫. প্রজাপতিটির যেন বহুরূপতা না থাকে। কারণ, বহু প্রজাপতির স্ত্রী ও পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন দেখতে হয়। আবার বহু প্রজাপতির রূপ একেক ঋতুতে একেকরকম হয়। সাধারণের মধ্যে এমন ঘটনা বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে।

৬, লার্ভাগুলি (শুঁয়োপোকা) যেন মানুষের পক্ষে অনিষ্টকর না হয়।

৭. যে সব প্রজাপতিকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার ‘রাজ্য প্রজাপতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে (যেমন মহারাষ্ট্র, কর্নাটক), তারা ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার যোগ্য নয়।

নর্দার্ন জাঙ্গলকুইন

চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রজাতিটিকে ‘জাতীয় প্রজাপতি’র স্বীকৃতির জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে পেশ করা হবে। এর জন্য সরকারি স্তরে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয়ের কাজও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। গগৈ বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত অনলাইন ভোটাভুটিতে ৩০ হাজারেরও বেশি নেটাগরিক অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা।’’ আর পশ্চিমবঙ্গ? অন্যতম উদ্যোক্তা অর্জন বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যের প্রায় ১,২০০ প্রকৃতিপ্রেমী ভোট দিয়েছেন। আশা করছি ৮ অক্টোবরের মধ্যে সংখ্যাটা আরও বাড়বে।’’

প্রাথমিক নির্বাচিত সাতটি প্রজাপতি:

১. ফাইভ-বার সোর্ডটেল (Graphium antiphates): অনবদ্য বর্ণবিন্যাস, লম্বা ছুরির ফলার মতো লেজ এর বৈশিষ্ট্য। পূর্ব হিমালয় এবং উত্তর-ভারতের রাজ্যগুলি-সহ পশ্চিমঘাট পর্তমালার চিরহরিৎ অরণ্যে বাস। উত্তরবঙ্গের জঙ্গলেও দেখা মেলে। দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটে আবাস একে প্রতিযোগিতায় অন্যতম ‘ফেভারিট’ করে তুলেছে।

২. কমন জেজেবেল (Delias eucharis): কলতাতা শহরের পার্কে এর উপস্থিতি। সেইসঙ্গে ভারতের প্রায় প্রতিটি অরণ্যেও। উজ্জ্বলদর্শন। হলুদ-কুমকুমে রাঙানো ডানার নীচের পিঠ। শরীরের উজ্জ্বল রং আসলে এর শত্রুদের প্রতি এক বার্তা— রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক। খেলেই সর্বনাশ।

কমন জেজেবেল

৩. ইন্ডিয়ান নবাব (Charaxes bharata / Polyura bharata): ভারতের আর্দ্র অরণ্যগুলোর বাসিন্দা এই প্রজাপতি খুব সুলভ না হলেও একটু আয়াসেই দেখা যেতে পারে। ডানায় ওড়ার জোর অসাধারণ। উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া-সহ রাঢ়বঙ্গের নানা জেলায় উপস্থিতি।

৪. কৃষ্ণা পিকক (Papilio krishna): যেমন বড় আকার, তেমনই ডানার রঙের বৈচিত্র। তাই ভারতের জাতীয় পাখির সঙ্গে নামের সাযুজ্য আছে। উত্তরবঙ্গ সহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির গভীর জঙ্গলে দেখা মেলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রজাপতি সঙ্কটের মুখে, তাদের একটি হল কৃষ্ণা পিকক। এর সংরক্ষণ তাই আরও বহু প্রজাতির সংরক্ষণে সহায় হবে। সংরক্ষণের পরিভাষায় এটি ‘ফ্ল্যাগশিপ স্পিসিস’।

৫. অরেঞ্জ ওকলিফ (Kallima inachus): এর উপর আর নীচের পিঠের রঙে বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে শত্রুর চোখে ধুলো দেবার জন্য। উপর পিঠে ঝলমলে কমলা আর নীলের পটি। অথচ নীচের পিঠ দেখতে অবিকল শুকনো পাতার মতো। উত্তরবঙ্গ, ওডিশা-সহ ভারতের বিভিন্ন আর্দ্র অরণ্যে এর বাস।

৬. নর্দার্ন জাঙ্গলকুইন (Stichophthalma camadeva): বিরাট ডানা, আর রঙের বৈচিত্রে এটিকে ভারতের অন্যতম সুদর্শন প্রজাপতি। উত্তর-পূর্ব ভারতে এদের আবাস। অরুণাচলের মিশমি জনজাতির মানুষেরা এর ডানার নকশা বোনেন তাঁদের পোশাকে।

ইয়েলো গরগন

৭. ইয়েলো গরগন: (Meandrusa payeni ): কাস্তের মতো বাঁক নেওয়া ডানার গড়ন প্রথমেই চমক লাগায়। সেইসঙ্গে রঙের ঔজ্জ্বল্য আর দ্রুতবেগে ওড়ার ক্ষমতা। উত্তরবঙ্গের এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি নদীর ধারে এর সন্ধান মেলে।

আরও পড়ুন: পূর্ব মেদিনীপুরের পুকুরে তরাইয়ের কচ্ছপের বসত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement