২০১১-র নির্বাচনে উত্তর করিমগঞ্জ আসনে তখনকার বিধায়ক, বিজেপির মিশনরঞ্জন দাসকে হারিয়ে কংগ্রেসের কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ জিতেছিলেন। এবারও লড়াই হয় সেই দুই পুরনো প্রতিপক্ষের। ফলাফল একই। রাজ্য জুড়ে বিজেপির এই জয়জয়কারের মধ্যেও মিশনবাবুকে হারিয়ে ফের বিধায়ক হয়েছেন কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ। তবে ব্যবধান কমে গিয়েছে অনেকটাই—৪৬৮।
আর সে কারণেই এ বার দলে তাঁর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে। বিধানসভার অধিবেশনে বরাক উপত্যকার কোনও বিষয়ে কথা বলতে হলেই কংগ্রেস পরিষদীয় দল কমলাক্ষবাবুকেই সামনে এগিয়ে দিচ্ছে। এর কারণ প্রবল গেরুয়া ঝড়ে দক্ষিণ অসমের ১৬ আসনে ১৩টিতেই যখন দলীয় প্রার্থীরা বিপর্যস্ত, সে সময় যে তিন জন রুখে দাঁড়িয়েছেন, উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক তাঁদের অন্যতম। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিজেপি-র সরকার যে হচ্ছে ভোটের আগেই তা প্রায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর মিশনবাবু অসমে গেরুয়াবাহিনীর প্রথম সারির নেতা। তিনবারের বিধায়ক। একবার পরিষদীয় দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। সংগঠনে রাজ্য কমিটির সহ-সভাপতি। কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে দল তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে। ফলে এমন মানুষটি চতুর্থবার বিধায়ক হলে যে মন্ত্রী হবেনই, তা বলার অপেক্ষা রাখেনি। গুরুত্বপূর্ণ দফতর পাওয়া তাঁর নিশ্চিতই ছিল। এত সব জেনেও ভোটাররা কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থের প্রতি যে আস্থা প্রকাশ করেছেন।
কমলাক্ষবাবু অবশ্য এই হারতে হারতে জিতে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না। তিনি আশা করছিলেন, মোদি ঝড় সুনামি হয়ে আছড়ে পড়লেও তাঁর একটি ভোটও কমবে না। এমন প্রত্যাশার কারণ? তাঁর দাবি, উত্তর করিমগঞ্জে একটি রাস্তাও ভালো ছিল না। গত ৫ বছরে জেলা সদরের অলিগলি থেকে আরম্ভ করে পূর্ত সড়কগুলিরও যথেষ্ট সংস্কার করা হয়েছে। তাঁর কথায়, রাস্তাঘাটের জন্যই যদি বরাকে কংগ্রেসের আসন কমে যায়, তাহলে অন্তত উত্তর করিমগঞ্জে দলের ভোট কমার কথা ছিল না। কমলাক্ষবাবু বলেন, ‘‘এত কম ভোটে জয়ী হব, তা ভাবতেও পারিনি!’’ জনগণের একাংশ কেন তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারলেন না, সেই কারণ নাকি এখনও তিনি খুঁজে চলেছেন।
প্রথমবার শাসক দলের বিধায়ক, এ বার বিরোধী। কমলাক্ষবাবুর আক্ষেপ, প্রথম বারের বিধায়ক হয়ে তিনি যতটা কাজ করতে পেরেছেন, এবার কংগ্রেসের সরকার হলে সেই অভিজ্ঞতায় অনেক বেশি কাজ করা যেত। কিন্তু জনগণ যে চিন্তাধারা নিয়ে সরকার পরিবর্তন করেছেন তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে না বলেই মনে করেন তিনি। কমলাক্ষবাবুর কথায়, বিজেপিতে ‘ওয়ান ম্যান রুল’ চলছে। দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্র নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই বিজেপির শেষ কথা। তিনি কোনওদিন ‘আমাদের সরকার’ বলেন না। বলেন আমার সরকার। যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী।
নোট বদলকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য কমলাক্ষবাবু প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, নিজের একগুঁয়ে মনোভাব জাহির করলেন তিনি। দেশের লক্ষ লক্ষ লোক বিপন্ন, তাতে তাঁর কিছু যায়-আসে না। কমলাক্ষবাবুর প্রশ্ন, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলাই কি ভারতীয় নাগরিকের একমাত্র কাজ। সকালে উঠে টাকার জন্য লাইন দেবেন আর রাতে খালি হাতে কিংবা টাকা নিয়ে ফিরবেন! বিজেপি সরকারের নোট বদল নিয়ে অবশ্য তার আপত্তি নেই। কিন্তু এ নিয়ে যে ধরনের জন-হয়রানি চলছে, তাতেই তাঁর আপত্তি। কোনও টিম-ওয়ার্ক না করে টাকা পরিবর্তনের জন্যই খেসারত দিচ্ছেন জনগণ, বক্তব্য উত্তর করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়কের। তিনি বলেন, অসম সরকারেরও একই অবস্থা। টিম-ওয়ার্ক নেই। যে যেমন খুশি কথা বলছেন। একের কথার সঙ্গে অন্যের মিল নেই। আবার সবারই কথায়-কাজে বিস্তর ব্যবধান। পরিবর্তনের আশায় জনগণ ভোট দিয়েছেন বটে, কিন্তু ন্যূনতম কোনও পরিবর্তন নেই।
কমলাক্ষবাবুর কথায়, ‘‘৫-৬ মাসেও কোনও কর্মসূচি পাকা করে উঠতে পারেননি সর্বানন্দ সরকার। ওঁরা কাজ করবেন কী করে।’’ সরকার জনগণের কতটা উন্নয়ন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ে তিনি। তাই বলে তাঁর কাজকর্ম বন্ধ থাকবে না বলেই তিনি জোর গলায় ঘোষণা করেছেন। হুঁশিয়ারির সুরেই তিনি বলেন, বিরোধী বিধায়ক বলে কোথাও উন্নয়ন-তহবিল থেকে উত্তর করিমগঞ্জকে বাদ দেওয়া হলে সাধারণ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবেন। বিধানসভার ভিতরেও উপযুক্ত চাপ সৃষ্টি করবেন। কমলাক্ষবাবু আশাবাদী, যে কোনও পরিস্থিতিতে উত্তর করিমগঞ্জের মানুষকে তিনি পাশে পাবেন।