প্রণব মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত কৌশলী ভাষণ দিয়েছেন রেশিম বাগ ময়দানে। আরএসএস-এর বিরুদ্ধে আগে যেমন অভিযোগের আঙুল তুলতেন প্রণব, বৃহস্পতিবার তা তিনি তোলেননি।
ঠিকানাটা এসএমএস-এ চলে এসেছিল। স্নেহনগরের যোগক্ষেম লে-আউট খুঁজে পেতে তাই খুব সমস্যা হল না। নাগপুর-ওয়র্ধা রোড ছেড়ে গলিতে ঢুকে কয়েক মিনিট এগোলেই বিদর্ভ আরএসএস-এর প্রান্ত প্রচার প্রমুখের বাড়ি। শুক্রবার সকাল থেকে ছুটির মেজাজেই অনিল সাম্বরে। সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের সমাপন অনুষ্ঠান ঘিরে এমন সাঙ্ঘাতিক হইচই আগে কখনও দেখেননি। গোটা দেশের মিডিয়া হাজির হয়েছিল নাগপুরে। সঙ্ঘের তরফ থেকে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এ ক’দিন একা হাতে সামলাতে হয়েছে। প্রণব-পর্ব সেরে তাই একটু যেন হাঁফ ছাড়ার ভঙ্গি। তবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সফর ঘিরে যা কিছু হল, তা নিয়ে আর খুব বেশি উচ্ছ্বাস দেখাতে রাজি নন প্রবীণ সঙ্ঘ নেতা। ‘‘যা হয়েছে, ভালই হয়েছে। প্রণবদার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল না,’’—সঙ্ঘ মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়া শুক্রবার এটুকুই।
এটা কিন্তু অনিল সাম্বরের ব্যক্তিগত অবস্থান নয়। আরএসএস সদর দফতরের অবস্থানই ব্যক্ত করছেন তিনি। প্রণব মুখোপাধ্যায় সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে এসেছেন বলে এই অনুষ্ঠান গোটা দেশের নজর কেড়েছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু এখন আর সে সব নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসতে রাজি নয় আরএসএস। শিক্ষা বর্গের তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠান মিলিয়ে টানা এক মাস প্রবল ধকল গিয়েছে। তাই শুক্রবার ঈষৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন মেজাজ সঙ্ঘ সদর দফতরেও।
নাগপুরের মহল এলাকায় আরএসএস-এর ‘মুখ্যালয়’। বছরভর কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে থাকে সঙ্ঘের এই সদর দফতর। থাকে মহারাষ্ট্র পুলিশও। বাঙ্কার, ওয়াচ টাওয়ার, মেটাল ডিটেক্টর, আগ্নেয়াস্ত্রের মাঝে দুর্গের চেহারা নিয়েছে হেডগেওয়ার ভবন। তবে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবৎ শুক্রবার আর সেখানে নেই। অন্য কর্মসূচি নিয়ে শহর ছেড়েছেন। ম্যাঙ্গালোর রওনা দিয়েছেন মনমোহন বৈদ্যও। দীর্ঘ দিন বাংলায় কাটিয়েছেন অশীতিপর শ্রীকৃষ্ণ মতলব। গড়গড় করে বাংলা বলেন। কিন্তু তিনিও শুক্রবার সঙ্ঘ সদর দফতরে নেই। সংগঠনের কাজে আকোলা গিয়েছেন। যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা হয় সঙ্ঘের হয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অধিকারী নন। অথবা দ্বিপ্রাহরিক ‘বিশ্রান্তি’তে। সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে এক প্রবীণ স্বয়ংসেবকের সঙ্গে কিছু কথা বলার সুযোগ মিলল। শিক্ষা বর্গে কত জন এসেছিলেন, ক’দিন ছিলেন, কোথায় তাঁদের রাখা হয়েছিল— সে সব প্রশ্নের টুকটাক জবাব তিনি দিলেন। কিন্তু শিক্ষা বর্গের সমাপন সমারোহে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যোগদান এবং প্রণবের ভাষণ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য তিনি করলেন না।
রেশিম বাগে সঙ্ঘের মঞ্চে মোহন ভাগবতের সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ভাষণে ‘জাত’ রক্ষা, তবু কংগ্রেসের হাসি মুছলেন প্রণব, খুশির হাওয়া সঙ্ঘে
বৃহস্পতিবার রেশিম বাগে আয়োজিত মেগা ইভেন্ট সেরে আরএসএস-এর প্রতিক্রিয়া ঠিক এই রকমই নিরুত্তাপ। অসন্তোষ নেই, উচ্ছ্বাসও নেই। মিশ্র এবং অত্যন্ত সংযত প্রতিক্রিয়া যেন।
সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হওয়ায় দেশ জুড়ে যে হইচইটা শুরু হয়েছিল, তা প্রণবকে যেমন অস্বস্তিতে ফেলেছিল, তেমনই অস্বস্তিতে ফেলেছিল সঙ্ঘকেও। দুঁদে রাজনীতিক প্রণব সে অস্বস্তি আচরণে প্রকাশ পেতে দেননি। জানিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে সে সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের জবাব দেবেন না, যা বলার নাগপুরেই বলবেন। কিন্তু সঙ্ঘ কার্যকর্তাদের কিছুটা বিচলিত হতে দেখা গিয়েছিল সে বিতর্কের মাঝে। সহসরকার্যবাহ মননোহন বৈদ্য বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, প্রণবকে নিয়ে এই বিতর্ক অনর্থক বলে মন্তব্য করেছিলেন। বৃহস্পতিবার সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতও একই প্রসঙ্গ দিয়ে নিজের ভাষণ শুরু করেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কেন আমন্ত্রণ জানানো হল, তা নিয়ে চর্চা ‘নিরর্থক’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে এই তুমুল হইচইয়ের মাঝে প্রণব মুখোপাধ্যায় সঙ্ঘের মঞ্চ থেকে শেষ পর্যন্ত কী বলবেন, তা নিয়ে আরএসএস নেতৃত্ব কিছুটা চিন্তিতই ছিলেন।
সঙ্ঘের মঞ্চে অভ্যর্থনা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে।
প্রণব মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত কৌশলী ভাষণ দিয়েছেন রেশিম বাগ ময়দানে। আরএসএস-এর বিরুদ্ধে আগে যেমন অভিযোগের আঙুল তুলতেন প্রণব, বৃহস্পতিবার তা তিনি তোলেননি। কিন্তু নিজের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ভারতের বহুত্ব, ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র এবং সহিষ্ণুতার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন। হেডগেওয়ারকে প্রণব ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’ আখ্যা দেওয়ায় সঙ্ঘ পরিবার নিঃসন্দেহে খুশি। কিন্তু দেশে অসহিষ্ণুতা এবং হিংসা বাড়ছে বলে যে মন্তব্য সঙ্ঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় করেছেন, তাতে স্বয়ংসেবকদের কিছুটা অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে। সমারোপ সমারোহ সেরে তাই সঙ্ঘের প্রতিক্রিয়া মিশ্র।
আরও পড়ুন: মেয়ের আশঙ্কাই সত্যি, নাগপুরে প্রণবের ভুয়ো ছবি ভাইরাল
বৃস্পতিবার সঙ্ঘমঞ্চে ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের এই অনুষ্ঠানকে নিয়ে এমন দেশজোড়া আগ্রহ আগে কখনও দেখেছেন? অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনিল সাম্বরে অকপটে বলেন, “না, এত হইচই আগে কখনও দেখিনি। এটা প্রণবদার জন্যই হয়েছে।” তা হলে উচ্ছ্বসিত নন কেন? গত সন্ধ্যতেই নিজের দল কংগ্রেসকে এত বড় অস্বস্তিতে ফেললেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, তা নিয়ে সঙ্ঘের উল্লাস কই? সঙ্ঘ মুখপাত্র বলেন, “উচ্ছ্বাসের সময় কোথায়? সারা বছরই আমাদের ঠাসা কর্মসূচি থাকে। কালকে সমারোপ শেষ হয়েছে, আজ সকালেই ভাগবত্জি, মনমোহনজি অন্য কর্মসূচিতে রওনা হয়ে গিয়েছেন। সঙ্ঘের একেবারের নীচের স্তর পর্যন্তই এ কর্মসূচি ভাগ ভাগ করে দেওয়া থাকে। কালকে যা হয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে আজ আর ভাবার অবকাশ নেই।
কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভাষণে আরও বেশি কিছু আশা করেছিলেন কি? স্বভাবসিদ্ধ সংযম নিয়ে সাম্বরে ফের বলেন, “না না, কোনও প্রত্যাশাই আমাদের ছিল না। আজীবন কংগ্রেস করে আসা প্রণব মুখোপাধ্যায় হঠাত্ সঙ্ঘের মঞ্চে এসে সঙ্ঘের হয়ে সওয়াল করতে শুরু করবেন, এমনটা কেনই বা ভাবব!”
ছবি: পিটিআই।