বাজেট অধিবেশনের শুরুতে, আর্থিক সমীক্ষা প্রকাশের দিন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সোমবার। ছবি: পিটিআই
এক প্রান্ত থেকে ধারালো পেস বোলিংয়ের মতো বেকারত্বের সমস্যা ধেয়ে আসছে। অন্য প্রান্ত থেকে মূল্যবৃদ্ধির বিষাক্ত সুইং। মোদী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝপথে, মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মঙ্গলবার সংসদে বাজেট পেশ করতে চলেছেন। তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ হল, আর্থিক বৃদ্ধির স্কোরবোর্ডে দ্রুত রান তুলতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়ে ফেলে উইকেট হারালে চলবে না।
অতিমারি-উত্তর অর্থনীতি তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। হাল অনেকটাই ফিরেছে। কোভিডের ধাক্কায় গত অর্থ বছরে জিডিপি-র প্রায় ৭.৩ শতাংশ সঙ্কোচন হয়েছিল। চলতি অর্থ বছরে প্রায় ৯.২ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি হবে বলে সরকারি পূর্বাভাস। কোভিডের বছরের সঙ্কুচিত জিডিপি-র তুলনায় আপাত ভাবে এই বৃদ্ধি অনেকটা বেশি মনে হচ্ছে। কোভিডের আগের বছরের তুলনায় অবশ্য জিডিপি-র বৃদ্ধি সামান্যই। আর্থিক সমীক্ষায় পূর্বাভাস, আগামী অর্থ বছরে বৃদ্ধির হার ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে।
দুশ্চিন্তার কারণ হল, বাজারে কেনাকাটা এখনও কোভিডের আগের বছরের তুলনায় কম। তার উপরে মূল্যবৃদ্ধি মাথাচাড়া দিয়েছে। ডিসেম্বরে খাদ্যপণ্যের দাম সামান্য কমলেও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম কমছে না। আজ আর্থিক সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি আগামী দিনে চিন্তার কারণ। অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলার ছুঁয়েছে। পাঁচ রাজ্যের ভোট মিটলেই ফের পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়ার আশঙ্কা। ওমিক্রনের পরে ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাস আবার কী রূপ নিয়ে হাজির হবে, কেউ জানে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফের কী বাধা আসবে, তা-ও অজানা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অনিশ্চয়তাটাই এখন একমাত্র নিশ্চিত বিষয়।
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা হল, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে এই সব রাজ্যের গ্রামের মানুষের জন্য কিছু সদর্থক বার্তা দেওয়া। যাতে তার সুফল বিজেপির ভোটের বাক্সে এসে পড়ে। বিশেষত তিন কৃষি আইন নিয়ে এক বছর ধরে গোঁ ধরে থাকার পরে নরেন্দ্র মোদী তা প্রত্যাহার করলেও, চাষি, গ্রামের মানুষের ক্ষোভে প্রলেপ দেওয়া জরুরি। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সে দিকে লক্ষ্য রেখে চাষিদের জন্য ভর্তুকিতে ঋণের জোগান অনেকটা বাড়ানো হতে পারে।
রাজনীতি সামলে অর্থনীতির দিক থেকে নির্মলা সীতারামনের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ পাঁচটি। এক, আর্থিক বৃদ্ধিকে যতটা সম্ভব ঠেলে তোলা। বেকারত্বের সমাধানে কর্মসংস্থান বা চাকরির সুযোগ তৈরি হয়। মানুষের আয় বাড়ে। ফলে কর্মসংস্থান তৈরি ও আয় বাড়ানো, এই দু’টি ক্ষেত্রে আলাদা ভাবেই অর্থমন্ত্রীকে নজর দিতে হবে। দুই, বাজারে কেনাকাটা বাড়ানো। তিন, রাজকোষের ঘাটতিকে যথাসম্ভব বাগে রাখা। চার, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানা। এবং পাঁচ, কোভিডের পরে অর্থনীতির হাল ফিরলেও ধনী, গরিবের হাল সমান ভাবে ফেরেনি। আর্থিক অসাম্য বেড়েছে। সমাজের নিচু তলার মানুষের কাছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রেও যাতে আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পৌঁছয়, তা নিশ্চিত করা।
অর্থমন্ত্রীর হাতে হাতিয়ার একটিই। পরিকাঠামোয় খরচ বা মানুষের হাতে নগদ জোগান বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। এই মুহূর্তে কঠোর আর্থিক সংস্কারের সুযোগ নেই। তিন কৃষি আইন নিয়ে অনড় থেকে, কৃষকদের আন্দোলন জিইয়ে রেখে মোদী সরকার নিজেই সংস্কার বিরোধী আবহ তৈরি করে ফেলেছে। বাকি থাকে ঋণ নীতি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমনিতেই সুদ কমিয়ে রেখেছে। আরও সুদের হার কমিয়ে শিল্পের জন্য সহজে ঋণের জোগান দেওয়া মুশকিল।
শিল্পমহল বলছে, বাজারে কেনাকাটা নিয়ে অনিশ্চয়তার জেরে তাঁরা এখন নতুন লগ্নি নিয়ে ভাবছেনই না। কারখানার উৎপাদন ক্ষমতাই পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। আমজনতার মতো শিল্পমহলও কাঁচা মালের দাম নিয়ে জেরবার। শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি তাই এখনও শ্লথ গতিতে চলছে। স্বাভাবিক ভাবে শিল্পমহলও চাইছে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মোদী সরকার পরিকাঠামোয় আরও খরচ করুক। মোদী সরকার মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুক। বাজারে কেনাকাটা বাড়ুক।
মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়াতে অর্থমন্ত্রী আয়করে ছাড় দিতে পারেন। আয়করে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন বাড়াতে পারেন। তাতে আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইতিমধ্যেই পেট্রল-ডিজ়েলে শুল্ক কমানো হয়েছে। অথচ বিলগ্নিকরণ থেকে যতখানি টাকা ঘরে তুলবেন বলে সীতারামন ভেবেছিলেন, এয়ার ইন্ডিয়া বেচে দিলেও তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। সবেধন নীলমণি এখন জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি-র আইপিও।
অর্থনীতিতে গতি আনতে জাতীয় পরিকাঠামো প্রকল্পের পাইপলাইন, রেল-সড়ক-বিমান-বন্দরের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরিতে গতি শক্তি প্রকল্পে জোর দিতে হবে। শুধু ঘোষণা ও বরাদ্দ নয়। রূপায়ণও দরকার। পরিকাঠামোর কাজ হলে ইস্পাত, সিমেন্টের মতো অনেকগুলো ক্ষেত্রে একসঙ্গে গতি আসবে। সরাসরি ও পরোক্ষ ভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে ছোট-মাঝারি শিল্প এবং শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। লকডাউনের ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। লকডাউনের সময় গ্রামে ফেরা মানুষের এখনও সবাই শহরে ফিরতে পারেননি। চাষ থেকে সামান্য আয় আর একশো দিনের কাজের ভরসায় থাকা মানুষের জন্য একশো দিনের কাজ ও খাদ্য ভর্তুকিতেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
চ্যালেঞ্জ হল, বেশি খরচ বা কর ছাঁটাই করতে গিয়ে রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়ে ফেললে চলবে না। গত বাজেটে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্য ছিল ৬.৮ শতাংশ। এবার তা কমিয়ে ৬ থেকে ৬.৩ শতাংশের ঘরে নিয়ে আসা জরুরি। ঘাটতি বাড়লে ধারদেনাও বেশি করতে হবে। সরকারই বাজার থেকে সিংহভাগ টাকা ধার নিয়ে ফেললে শিল্পমহল যদি নতুন লগ্নির কথা ভেবে ঋণ নিতে যায়, তা হলে মুশকিলে পড়বে। তা ছাড়া, সরকারের ঘাড়ে এমনিতেই বিপুল দেনা। সুদ মেটাতেই রাজস্ব আয়ের প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে যাওয়ার দশা। অশোধিত তেলের দাম বাড়লে আমদানির খরচ বাড়বে। অর্থমন্ত্রীকে তাই এমন জায়গায় খরচে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। দেশের সব চেয়ে বড় রাজ্যে ভোটের মুখে বাজেট পেশ করতে যাওয়া নির্মলা সীতারামনের পক্ষে কাজটা যথেষ্ট কঠিন, তাতে সন্দেহ নেই!