সাত বছরের উপর বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন নির্ভয়ার মা আশাদেবী। ছবি: এএফপি।
অবশেষে একটা বৃত্ত সম্পন্ন হল। ফাঁসি দেওয়া হল নির্ভয়ার গণধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের চার জীবিত সাবালক দোষী— মুকেশ সিংহ, পবন গুপ্ত, বিনয় শর্মা এবং অক্ষয় ঠাকুরকে। সওয়া সাত বছর ধরে চলা জটিল আইনি মারপ্যাঁচের পর শেষমেশ বিচার পেল নির্ভয়া ও তাঁর পরিবার। কিন্তু ন্যায় পেল কি?
কথায় বলে ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড’। নির্ভয়ার ক্ষেত্রেও কি সেটাই হল না? সেই ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরেই চার দোষীকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছিল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। তার পরেও চার দোষীর ফাঁসি হতে লেগে গেল সাত বছরের বেশি।
এ ক্ষেত্রে আইনের জটিলতাকে দারুণ ভাবে কাজে লাগালেন দোষীদের আইনজীবীরা। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই দেশ কাঁপানো রাতের পর থেকেই, গোটা দেশের নজর থেকেছে এই মামলার দিকে। কিন্ত যত বারই মনে হয়েছে এ বার হয়তো সাজা পাবে দোষীরা, তখনই বিকল্প রাস্তা খুঁজে বার করেছেন তাদের আইনজীবীরা। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত, উচ্চ আদালত থেকে শীর্ষ আদালত, শীর্ষ আদালত থেকে কিউরেটিভ পিটিশন, রিভিউ পিটিশন। বিগত সাড়ে সাত বছরে বারে বারে পিছিয়েছে ওই চারজনের ফাঁসি। আর চোখের জল ফেলে নির্ভয়ার মা আশা দেবী পেয়েছেন শুধু ‘তারিখ পে তারিখ’। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘কবে হবে ফাঁসি?’ যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার...
রাজধানীর রাজপথে এই বাসে উঠিয়েই গণধর্ষণ এবং অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল নির্ভয়ার উপর। ছবি: পিটিআই।
১৬ ডিসেম্বর ২০১২ – একটা কালো দিন হয়ে থাকবে ভারতের ইতিহাসে। সে দিন রাতে দক্ষিণ দিল্লির মুনিরকায় এক তরুণীর উপর চলা নির্যাতনের বীভৎসতা স্তম্ভিত, লজ্জিত, ক্রুদ্ধ করেছিল গোটা দেশকে। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুয়ায়ী, সে বছর শুধুমাত্র দিল্লিতেই ৭০৬টি ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছিল। তার পর পেরিয়েছে সাতটা বছর। সে রাতের দোষীরা ফাঁসিকাঠে উঠল। সাত বছর ধরে বিচারপর্ব চলার পর একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
দিনটা ছিল একটা রবিবার। বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফিরছিলেন বছর ২৩-এর প্যারামেডিক্যালের ছাত্রী। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ দক্ষিণ দিল্লির মুনিরকা থেকে বাস ধরেছিলেন ওঁরা দু’জন। পরবর্তী এক ঘণ্টায় বদলে যায় ওঁদের জীবন। বাসের মধ্যে তরুণীকে গণধর্ষণ, অকথ্য অত্যাচার। ওই দুষ্কর্মে জড়িত ছিল বাস ড্রাইভার-সহ ছ’জন। যাদের মধ্যে একজন আবার নাবালক।
রাত ১১টা নাগাদ, দু’জনকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাস্তার ধার থেকে। জামাকাপড় ছিঁড়ে, রক্তে ভেসে যাওয়া দুটো শরীর। সফদরজঙ্গ হাসপাতালে শুরু চিকিৎসা। সারা দেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই খবর। দেশ জুড়ে শুরু হল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। দেশ ওই তরুণীর নাম রাখল নির্ভয়া।
২ দিন পর
১৮ ডিসেম্বর – গ্রেফতার চার অভিযুক্ত - বাসচালক রাম সিংহ, ভাই মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত।
৫ দিন পর
২১ ডিসেম্বর – দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাস থেকে গ্রেফতার নাবালক।
সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চার্জশিট পেশ করে দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আবেদন জানানো হবে আদালতে।
৬ দিন পর
২২ ডিসেম্বর – বিহারের অওরঙ্গাবাদ থেকে গ্রেফতার আর এক অভিযুক্ত অক্ষয় ঠাকুর।
১১ দিন পর
২৭ ডিসেম্বর – অবস্থার অবনতি হওয়ায় নির্যাতিতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।
দেশ জুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির দাবি এতই জোরালো হতে শুরু করল যে, বৈঠকে বসল সংসদের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটি।
বর্মা কমিটির সুপারিশ মেনে পাঁচটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠনে সবুজ সঙ্কেত দিল্লি হাইকোর্টের।
১৩ দিন পর
২৯ ডিসেম্বর – জীবন যুদ্ধে জেতা হল না, ফেরা হল না দেশে। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালেই মারা গেলেন নির্যাতিতা। দেখে যেতে পারলেন না বিচার পর্ব।
শুধু পরিবার নয়, দেশের মেয়ে হয়ে উঠলেন নির্ভয়া। ছবি: পিটিআই।
২০১৩
নারী সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে নির্ভয়া ফান্ড তৈরি করল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের তরফে দেওয়া হল ১০০০ কোটি টাকা।
পাশ হল ক্রিমিনাল ল অর্ডিন্যান্স— যাতে ধর্ষণের ঘটনায় সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হল।
মার্কিন বিদেশ দফতর সাহসিকতার জন্য নির্ভয়াকে মরণোত্তর ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড দিল।
১৭ দিন পর
২ জানুয়ারি – সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর সাকেত আদালতে ধর্ষণ সংক্রান্ত প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের সূচনা করলেন।
৩ জানুয়ারি – চার্জশিট দাখিল করল পুলিশ। ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, প্রমাণ লোপাট-সহ একাধিক ধারা এবং নির্ভয়ার বন্ধুকে খুনের চেষ্টার চার্জ গঠন করল আদালত।
১৭ জানুয়ারি – ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার শুরু পাঁচ অভিযুক্তের।
৮৫ দিন পর
১১ মার্চ – তিহাড় জেলে আত্মহত্যা করল অন্যতম অভিযুক্ত রাম সিংহ।
সাড়ে ৬ মাস পর
৮ জুলাই – শুনানি শেষ। পুলিশের কাছে অপরাধের কথা কবুল করলেও আদালতে গিয়ে বেঁকে বসল ৪ অভিযুক্ত। তাদের আইনজীবীরা দাবি করেন, জোর করে জবানবন্দি নিয়েছে পুলিশ। তবে নির্ভয়ার বন্ধুর বয়ান, আঙুলের ছাপ, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ, অপরাধীদের বিরুদ্ধে যায়।
সাড়ে ৮ মাস পর
৩১ অগস্ট – গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় প্রথম দোষী সাব্যস্ত। তবে ঘটনার দিন ওই যুবকের বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় আইনের চোখে সে ছিল নাবালক। তাই গোটা বিচার প্রক্রিয়াই চলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে। দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হিসেবে তাকে পাঠানো হয় হোমে।
শোনা যায় এই নাবালকই সব চেয়ে বেশি অত্যাচার চালিয়েছিল ওই তরুণীর উপর।
আন্দোলনের অন্য রূপের জন্ম দিয়েছিল নির্ভয়া-কাণ্ড। ছবি: পিটিআই।
৯ মাস পর
১৩ সেপ্টেম্বর – বাকি চার অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত। এই ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ আখ্যা দিয়ে বিচারক যোগেশ খন্না চারজনকেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনালেন। অপরাধীদের আইনজীবীদের আর্জি খারিজ করে বিচারক খন্না বলেন, এই ঘটনা ‘‘ভারতবাসীর সমবেত বিবেককে ধাক্কা দিয়েছে। তাই আদালত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে না।’’
চার প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষক-খুনিই নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে সাজা কমানোর আর্জি জানায়।
২০১৪
১৫ মাস পর
১৩ মার্চ – দিল্লি হাইকোর্টে বিচারপতি রেভা ক্ষেত্রপাল এবং প্রতিভা রানির বেঞ্চ বহাল রাখল নিম্ন আদালতের রায়।
১৫ মার্চ – মৃত্যুদণ্ডে স্থগিতাদেশ সুপ্রিম কোর্টের, ন্যায্য বিচার হয়নি।
২০১৫
২ বছর ২ দিন পর
১৮ ডিসেম্বর – নাবালকের মুক্তিতে স্থগিতাদেশের আবেদন খারিজ, ছাড়া পেল নাবালক। সেলাই মেশিন কিনে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য দেওয়া হল ১০ হাজার টাকা।
২২ ডিসেম্বর – রাজ্যয়সভায় পাশ হল জুভেনাইল জাস্টিস বিল – বলা হল ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ১৬ বছরের উপর বয়স হলে হলে প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গেই বিচার হবে।
২০১৬
৩ বছর ৩ মাস পর
৩ এপ্রিল – ১৯ মাসের বিরতির পর সুপ্রিম কোর্টে ফাস্ট ট্র্যাক মোডে শুনানি শুরু বিচারপতি দীপক মিশ্র, গোপাল গৌড় এবং কুরিয়েন জোসেফের এজলাসে।
২০১৭
৪ বছর ১ মাস ১৮ দিন পর
৩ ফেব্রুয়ারি – নতুন করে মামলা শোনার সিদ্ধান্ত, কারণ দোষীদের আইনজীবীদের অভিযোগ ছিল অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক প্রক্রিয়া মেনে চলা হয়নি।
৪ বছর ৫ মাস পর
৫ মে – দিল্লি হাইকোর্টের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট
ওই বছরই ডিসেম্বরের মধ্যে তিন অভিযুক্তই সুপ্রিম কোর্টে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি দাখিল করল
২০১৮
সাড়ে ৫ বছর পর
৯ জুলাই – তিন ধর্ষক-খুনির সাজা পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করল তত্কালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ।
২০১৯
৬ বছর ১১ মাস পর
১০ ডিসেম্বর– মৃত্যুদণ্ড পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে ফের সুপ্রিমে কোর্টের দ্বারস্থ অক্ষয় ঠাকুর
১৩ ডিসেম্বর– এই রিভিউ পিটিশনের বিরোধিতা করে শীর্ষ আদালতে গেলেন নির্ভয়ার মা
৭ বছর ২ দিন পর
১৮ ডিসেম্বর– অক্ষয় ঠাকুরের রিভিউ পিটিশন খারিজ শীর্ষ আদালতের
আদালতের কাছে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারির আর্জি জানাল দিল্লি সরকার
১৯ ডিসেম্বর– ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল, পবন গুপ্তর দাবি উড়িয়ে আবেদন খারিজ দিল্লি হাইকোর্টের।
২০২০
সাত বছর ২২ দিন পর
৭ জানুয়ারি, ২০২০
পাতিয়ালা হাউস কোর্ট জানিয়ে দিল ২২ জানুয়ারি সকাল ৭টায় চার অপরাধী মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় ঠাকুরকে ফাঁসি দেওয়া হবে।
সাত বছর ৩২ দিন পর
১৭ জানুয়ারি, ২০২০
বিনয় এবং মুকেশের রায় সংশোধনের আর্জি খারিজ সুপ্রিম কোর্টে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ফাঁসির দিন ধার্য হল। কিন্তু ফাঁসি হল না ওই দিনও। নতুন নতুন আবেদনের জেরে, এর পর ৩ মার্চ, তার পর ২০ মার্চ ফাঁসির দিন ধার্য করে দিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্ট।
সাত বছর তিন মাস চার দিন পর
২০ মার্চ, ২০২০
ফাঁসি হয়ে গেল এই দশকের সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা অপরাধ-কাণ্ডের চার অপরাধীর