ছবি সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার পরে আস্তিনে তুরুপের তাসটি লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন উপযুক্ত সময়ের। আজ সরযূ নদীর তীরে অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস সেরে, নরেন্দ্র মোদী সেই ‘রাম-বাণ’ ছুড়লেন বিরোধীদের দিকে।
২৯ বছর পর অযোধ্যায় গেলেন মোদী। আর গিয়ে, দু’বছর পরে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ও চার বছর পর লোকসভা ভোটের প্রচার কৌশলের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তরটিও স্থাপন করলেন। রামমন্দিরকে দেশের বিভিন্ন বিভেদের মধ্যে ঐক্যস্থল হিসেবে তুলে ধরে, অযোধ্যার মাটি থেকে হিন্দুত্ববাদী স্বপ্নকে পৌঁছে দিলেন গোটা দেশে। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ভূয়সী প্রশ্ংসা করে (উৎসাহী, সক্রিয় এবং প্রতিভাসম্পন্ন) তাঁকে উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিজেপির মুখ হিসেবেও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন।
রামমন্দির নিয়ে মোদীর তৈরি করা আবেগের ঢেউ সামলাতে বিরোধীরা পাল্টা কী চিত্রনাট্য তৈরি করবেন, তা সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে। কিন্তু আজ কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বিএসপির নেতারা মোদী রচিত রামবন্দনার অবস্থানকে আক্রমণ করতে পারেননি। বরং গত কাল প্রিয়ঙ্কা বঢরার মতো আজ রাহুল গাঁধী, অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীরা প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর তৈরি করে দেওয়া রাম সড়কেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। রাহুল টুইটে প্রচ্ছন্ন ভাবে মোদী সরকারের সমালোচনা করতে চেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা সেই রাম প্রশস্তির মাধ্যমেই। প্রিয়ঙ্কা বলেছিলেন, ‘‘ভগবান রাম সবার জন্য। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের ঐক্যের প্রতীক। রাম সবার কল্যাণ চেয়েছেন তাই তাঁকে পুরুষোত্তম বলা হয়। আশা করি, রামমন্দিরের শিলান্যাসের অনুষ্ঠান দেশের একতা ও সৌভ্রাতৃত্বকে তুলে ধরতে পারবে।’’ আর আজ রাহুলের বক্তব্য, রাম প্রেমের প্রতীক, ঘৃণার নন। রাম করুণার প্রতীক, কখনও তিনি নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না। রাম মানে ন্যায়, অন্যায় নয়।
আরও পড়ুন: কুম্ভকলস এনেছিলেন মোদী
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাহুলের মধ্যে যে টুকু সমালোচনার স্বর রয়েছে, সেটুকুও দেখা যায়নি উত্তরপ্রদেশে বিজেপির দুই প্রধান প্রতিপক্ষ বিএসপি ও সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে। মুলায়ম সিংহ যাদবের পুত্র অখিলেশ আজ রামের পাশাপাশি হনুমান বন্দনাও করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জয় মহাদেব, জয় সিয়ারাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় হনুমান।’’ টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘আশা করব, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রামের মর্যাদা পালন করবে।’’ আর বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর টুইট, ‘‘সবাই জানেন অযোধ্যা বহু ধর্মাবলম্বীর এক পবিত্র স্থান। তবে দীর্ঘ দিন ধরে রামমন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কে এই শহর জড়িয়ে ছিল। শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপে সেই বিতর্ক শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রামমন্দিরের শিলান্যাস হল। সে জন্য শীর্ষ আদালতকে ধন্যবাদ। বিএসপি গোড়া থেকেই বলে আসছে যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানা হবে। আমাদের পরামর্শ, সবাই সেটা মানুন।’’
রাজনৈতিক সূত্রের মতে, রামমন্দিরের হাওয়ায় হিন্দু ভোটের দিকে তাকিয়েই এই সব বিরোধী দলগুলির পক্ষে পাল্টা কিছু বলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মায়াবতীর মাথার উপর ঝুলছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার খাঁড়া। গত লোকসভা নির্বাচনের পরেই তিনি লড়াইয়ের অভিমুখ ঘুরিয়ে কংগ্রেসের দিকে করেছেন। উদ্দেশ্য, কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্ককে নিজের দলিত ভোট ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত করা। তাঁর ধারণা, যোগীর উপর ব্রাহ্মণেরা বিরূপ হয়ে রয়েছে এবং তারা কংগ্রেসের দিকে ফিরতে পারে। কিন্তু আজ আদিত্যনাথকে পাশে রেখে প্রধানমন্ত্রী যে মেগা শো করলেন, তাতে উত্তরপ্রদেশে যোগী-বিরোধিতার মেঘ অনেকটাই কেটে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে অখিলেশ-মায়াবতীদের থেকে ভিন্ন পথে হেঁটে আজ মোদী বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছেন এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আজ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। কারণ, বাবরি মসজিদ প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে ওখানে দাঁড়িয়েছিল।’’ ওয়েইসির মন্তব্য, ‘‘আজ ধর্মনিরপেক্ষতার পরাজয় হল, জয় হল হিন্দুত্বের। প্রধানমন্ত্রী কুর্সিতে বসার আগে যে শপথ নিয়েছিলেন, তা ভঙ্গ করলেন তিনি।’’
আরও পড়ুন: ‘ফাঁকা’ মাঠে তিনি এবং তিনিই
শিলান্যাস করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আজ বলেন, ‘‘রাম সর্বত্র, সবার মধ্যেই রয়েছেন। এটি গোটা দেশের জন্য এক আবেগঘন মুহূর্ত। এক দীর্ঘ অপেক্ষার আজ অবসান ঘটল।’’ দেশের ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক মানচিত্রকে একসঙ্গে উচ্চারণ করেছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘কন্যাকুমারী, কোটেশ্বর, কামাখ্যা, জগন্নাথ, সারনাথ, সোমনাথ, কাশী বিশ্বনাথ, বোধগয়া, অমৃতসর, পটনা সাহিব, আন্দামান, অজমের, লক্ষদ্বীপ, লে— রামনামে সবাই উদ্বেলিত।’’ রামমন্দিরকে আধুনিক ভারতের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে মোদী বলেছেন, ‘‘এই মন্দির জাতীয় আবেগের প্রতিফলন ঘটাবে। এটি কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত সংকল্প।’’
মোদী আজ বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে যেমন দলিত আদিবাসী পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের মানুষ সহায়তা করেছিলেন, একই ভাবে রামমন্দিরের কাজ শুরু হচ্ছে দেশের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। মন্দির নির্মাণ ও উত্তরপ্রদেশের ভবিষ্যৎকে একই বন্ধনীতে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য, “রামমন্দির নির্মাণে শুধু অযোধ্যার সৌন্দর্য্য বাড়বে, এমনটা নয়। গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি আমূল বদলে যাবে। সমস্ত ক্ষেত্রে অনেক নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
গোটা বিশ্ব থেকে মানুষ আসবেন ভগবান রাম এবং জানকী মায়ের দর্শন করতে। এই মন্দির হয়ে উঠবে কোটি কোটি মানুষের সংকল্প।’’