বিজয় দিবসে নয়াদিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী। (পাশে) দেহরাদূনে প্রাক্তন সেনাদের সংবর্ধনা রাহুল গাঁধীর। ছবি পিটিআই।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বাদ ইন্দিরা গাঁধী!
একাত্তরের যুদ্ধের পঞ্চাশতম বিজয় দিবস উদ্যাপনে বৃহস্পতিবার মোদী সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নামোচ্চারণও করা হল না। আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চে স্মরণ করলেন একাত্তরকে। সাধুবাদ জানালেন মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মোৎসর্গের, ভারতীয় সেনার জয়গান গাইলেন। কিন্তু যিনি এই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান রূপকার, সেই ইন্দিরার নাম উচ্চারণ করতে দেখা গেল না তাঁদের কাউকেই। মোদীর টুইট, “বিজয় দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সিংহহৃদয় ব্যক্তিত্বদের মহান শৌর্য ও আত্মবলিদানকে স্মরণ করছি। আমরা একসঙ্গে অত্যাচারী শক্তির সঙ্গে লড়াই করে তাদের হারিয়েছিলাম। আজ ঢাকায় রাষ্ট্রপতিজির উপস্থিতি প্রত্যেক ভারতীয়ের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।”
বুধবারই কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছিল। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এ কে অ্যান্টনি অভিযোগ তোলেন, একাত্তরের যুদ্ধের পরে ইন্দিরা গাঁধীকে দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু গত এক বছর ধরে সেই যুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপন চললেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক বারও ইন্দিরা গাঁধীর নামটুকু উচ্চারণ করেননি। আজ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে মোদীর তীব্র সমালোচনা করলেন রাহুল গাঁধী এবং প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। দেহরাদূনে এক জনসভায় রাহুল বলেন, “আজ দিল্লিতে বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গাঁধীর নামও উল্লেখ নেই। যে নারী এই দেশের জন্য ৩২টি বুলেট নিয়েছিলেন, তাঁর নাম আমন্ত্রণপত্রে ছিল না, কারণ এই সরকার সত্যকে ভয় পায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান ১৩ দিনের মধ্যে মাথা নত করেছিল।’’ প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্য, সাধারণত একটি যুদ্ধ ৬ মাস বা এক থেকে দু’বছর ধরে চলে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ লড়তে আমেরিকার ২০ বছর লেগে যায়। কিন্তু ভারত পাকিস্তানকে ১৩ দিনের মধ্যে হারিয়েছিল, কারণ ভারত ঐক্যবদ্ধ ছিল। টুইটারেও রাহুল লেখেন, “১৯৭১-এর যুদ্ধে নিহত শহিদ এবং সেনাদের স্মরণ করছি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারত জয়লাভ করে, গণতন্ত্রের ধারণাটিকে বাঁচায়।”
পাশাপাশি প্রিয়ঙ্কা টুইট করে বলেন, “আমাদের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে এই নারীবিদ্বেষী বিজেপি সরকারের বিজয় দিবস উদ্যাপন থেকে বাদ দেওয়া হল। নরেন্দ্র মোদীজি, নারীরা আপনার সাজানো কথায় বিশ্বাস করেন না। আপনি যে ভাবে বিষয়টির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। এ বার সময় এসেছে, নারীদের প্রাপ্যটুকু মিটিয়ে দেওয়া শুরু করুন।” আজ কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে, গৌরব গগৈ সংসদের বাইরেও এ নিয়ে সরব হয়েছেন। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা টুইট করে বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বিজয় দিবসে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের কর্তারা একাত্তরের যুদ্ধের ‘আয়রন লেডি’, ইন্দিরা গাঁধীজির নাম পর্যন্ত নেননি। এটিই তাঁদের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার উদাহরণ।”
রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, গত মার্চ মাসে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা গিয়েছিলেন, তখনও তাঁর বক্তৃতায় ইন্দিরা গাঁধীর নামোল্লেখ ছিল না। বরং তিনি দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জেরে তাঁকেই কারাবাস করতে হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে তখনই বিতর্ক তৈরি হয়। কংগ্রেস শিবিরের বক্তব্য, শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গাঁধীকে অস্বীকার করা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করাই নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও নতুন করে লিখতে চাইছেন মোদী। তিনি স্বচ্ছ ভারতের লোগোতে নিয়েছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর চশমাটি। সাবরমতী আশ্রমে গেলেই চরকায় সুতো কাটতে বসে যান। চম্পারণ সত্যাগ্রহের শতবর্ষও উদ্যাপন করেন। এমনকি স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদ্যাপনকে মোদী বিজেপির আপন সম্পত্তি করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন কংগ্রেস নেতারা। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, এটা শুধু জাতীয়তাবাদী বা রাজনৈতিক চাল নয়, নির্বাচনী কৌশলও। মোদীর জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা, কংগ্রেসের থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও ‘আইকন’-দের ছিনিয়ে নেওয়ার এই কৌশল কংগ্রেসকে হীনবল করার জন্যই। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, মহাত্মা গাঁধী গুজরাতের সন্তান, তিনিও গুজরাতের— অনেকটা সেই অধিকারেই কংগ্রেসের থেকে গাঁধীকে ছিনিয়ে এনে গত সাত বছরে বার বার নিজের এবং নিজের সরকারের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সংযোগ ঘটিয়েছেন মোদী। তিনি ইতিহাসের কোনও বিচারেই যাচ্ছেন না।
এ দিন রাহুলের দেহরাদূনের জনসভার মঞ্চে হাজির ছিলেন একাত্তরের যুদ্ধের সেনানীরা। সদ্যপ্রয়াত চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়তের কাটআউটও ছিল সভায়। বিজেপির অভিযোগ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা এবং রাওয়তের আবেগ কাজে লাগিয়ে উত্তরাখণ্ডের আসন্ন ভোটে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে কংগ্রেস।