নেপালের জনকপুর মন্দিরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
‘রামের জন্মভূমি’ অযোধ্যা এত দিন রাজনীতির হাতিয়ার ছিল। এ বার ‘সীতার জন্মভূমি’ মিথিলাকে কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার।
চলতি বিশ্বাস অনুযায়ী রামায়ণের অযোধ্যা এখন উত্তরপ্রদেশে। আর সেই মিথিলা নাকি এখনকার নেপালের তরাই এলাকার জনকপুর। মিথিলার রাজা জনকের নামেই সীতার ‘জন্মভূমি’র নাম এখন জনকপুর।
নেপালের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে এ বার মোদী সরকার অযোধ্যা ও জনকপুরকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলার পথে হাঁটল। অযোধ্যা ও জনকপুরকে সম্প্রতি যমজ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেই থামছে না নয়াদিল্লি। “রামায়ণ পরিক্রমা পথ” বা পর্যটন সার্কিটে ভারতের অযোধ্যা-সহ অন্যান্য রামায়ণের সঙ্গে জড়িত তীর্থস্থানের সঙ্গেই জুড়ে ফেলা হবে নেপালের জনকপুরকে। এখানকার জানকী মন্দির সীতার জন্মস্থানের উপরেই তৈরি বলে কথিত। রয়েছে রাম ও সীতার বিবাহমণ্ডপও। সেই মন্দিরে পুজো দিয়েই আজ প্রণব ঘোষণা করেন, এই পরিক্রমা পথে জনকপুরের তীর্থযাত্রীদের জন্য দুটি ধর্মশালা তৈরি করবে ভারত। যাতে আরও বেশি সংখ্যায় তীর্থযাত্রী জনকপুরে আসতে পারেন।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র নেপালেই হিন্দুরা সংখ্যাগুরু। সেই নেপালের মন জিততে হিন্দুত্ব ও কূটনীতির এই ‘ককটেল’ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না নয়দিল্লির সামনে। কারণ নেপালের তরাই এলাকার জনকপুরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মদেশীয়রাই সংখ্যাগুরু। নেপালের সংবিধানে সমানাধিকারের দাবিতে এই মদেশীয়রাই গত বছর অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলেছিল। কাঠমান্ডুতে তেল ও জরুরি পণ্যের জোগানে টান পড়ে। একে ভারতেরই প্ররোচনা ও অঘোষিত অবরোধ হিসেবে দেখেছে নেপাল। অভিযোগ উঠেছে, ভারতই কাঠমান্ডুর উপর চাপ তৈরি করে নেপালের সংবিধান তৈরিতে নাক গলাতে চাইছে। কাঠমান্ডু থেকে নেপালের অধিকাংশ এলাকাতেই ভারত সম্পর্কে এখনও গভীর বিদ্বেষ বাসা বেঁধে রয়েছে।
সেই বিদ্বেষ দূর করে ফের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতেই নেপাল সফরে এসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নয়াদিল্লি মদেশীয়দের উপর নিজের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের জন্য কাঠমান্ডুর প্রচণ্ড-সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। সেই কারণেই রাষ্ট্রপতির সফরসূচিতে এ বার সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা ছিল জনকপুর। শুক্রবার মদেশীয় অধ্যুষিত জনকপুরের জানকী মন্দিরে পৌঁছে রাম-সীতার মূর্তির সামনে মেঝেতে আসন করে বসে পুজো দেন প্রণব। তারপর জনকপুরের নাগরিক সম্বর্ধনায় বলেন, “রাজা দশরথ ও রাজা জনক যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, অযোধ্যা ও জনকপুরের মানুষ তারই উত্তরাধিকারী। ভারতের মানুষ সেই সম্পর্ককে মূল্য দেয়’’
মদেশীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখলেও প্রণব মদেশীয় নেতাদের বুঝিয়েছেন, সংবিধান তৈরিতে প্রচণ্ড-সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করতে। কাঠমান্ডুতে প্রণবের সঙ্গে দেখা করে মদেশীয় নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, নেপাল সরকার তাঁদের বরাবর ঠকিয়েছে। এ বার সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রেও ঠকাবে। সংবিধানে তাঁদের সমান নাগরিক অধিকার বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। দিল্লি রওনা হওয়ার আগে প্রণব বলেন, “ওঁদের বলেছি, সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। নেপাল সরকারকেও সংবিধান তৈরির সময় সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে চলতে হবে। ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। কারণ সংবিধান চিরস্থায়ী নথি। আসা করি, বাকি সমস্যা মিটে যাবে।’’ নেপালের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিও মিটে যাবে বলেও যুক্তি দিয়ে প্রণবের দাবি, ভারত-নেপালের দু দেশের সীমান্ত খোলা হলেও তার অপপ্রয়োগ হবে না। দু দেশেরই যে শত্রু রাষ্ট্র এর সুবিধা নিতে চায়, তাদেরও আটকাতে নেপাল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক কতখানি গভীর, তা বোঝাতে শুক্রবার দিল্লি রওনা হওয়ার আগে পোখরায় ভারতীয় সেনা থেকে অবসরপ্রাপ্ত নেপালের গোর্খা জওয়ানদের সভায় যোগ দেন প্রণব। মনে করিয়ে দেন, এখন ভারতে ৩২ হাজার গোর্খা জওয়ান কাজ করছে। প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার অবসরপ্রাপ্ত জওয়ান পেনশন পাচ্ছেন। যার পরিমাণ ৩১০০ কোটি নেপালি টাকা। গোর্খা জওয়ানরা সপ্তম বেতন কমিশন ও এক পদ এক পেনশন নীতির সুবিধাও পাবেন। প্রণবের কথা থেকেই স্পষ্ট, রাম-সীতার মেলবন্ধনের পাশাপাশি সেনায় গোর্খা-জওয়ানদেরও ভারত-নেপাল মৈত্রীর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে নয়াদিল্লি।
আরও খবর...
চ্যানেল বন্ধ: তুমুল নিন্দায় মুখ খুলে কেন্দ্র বলল, দেশের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত