সার্ক সম্মেলন বয়কটই শুধু নয়, পাকিস্তানকে এ বার অন্য প্রতিবেশীদের থেকে একেবারে একঘরে করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। ঠিক যে কথা ক’দিন আগে কোঝিকোড়ের বক্তৃতায় বলেছিলেন তিনি। মোদীর উদ্দেশ্য, সার্ক দেশগুলি থেকে ইসলামাবাদকে বিচ্ছিন্ন করে, তাদের উপর এক অদৃশ্য আঞ্চলিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা সমান্তরাল একটি সার্ক-গোষ্ঠীর কথা ভাবছি, যেখানে পাকিস্তান থাকবে না!’’
উরি কাণ্ডের পর পাকিস্তানকে গোটা বিশ্বেই একঘরে করার রণকৌশল নিয়েছে মোদী সরকার। সমান্তরাল সার্ক গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা তারই অংশ বলেই জানাচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক। বিশ্বের বড় মঞ্চগুলিতে তো বটেই, প্রতিবেশীদের কাছেও পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে চলেছে নয়াদিল্লি। এই দেশগুলির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক স্তরে সমন্বয়ের প্রস্তুতি আগেই শুরু হয়েছিল। যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস বিরোধী কাজকর্ম— সব ক্ষেত্রেই সমন্বয়ে কী ভাবে গতি আনা যায়, এখন সেই চিন্তা শুরু হয়েছে।
সন্ত্রাসে জীর্ণ আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য তৈরি হওয়া ৪৩টি দেশের সংগঠন ‘হার্ট অব এশিয়া’-র এ বারের আয়োজক দেশ ভারত। ডিসেম্বরে সম্মেলনটি হবে অমৃতসরে। বিভিন্ন দেশের বিদেশমন্ত্রীদের নিয়ে তৈরি এই গোষ্ঠীতে রয়েছে পাকিস্তানও। তবে ইসলামাবাদের সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ভারত বয়কট করার পর, অমৃতসরে পাক প্রতিনিধিকে পাঠানো শরিফের কাছে সঙ্কটের কারণ হবে। আবার ইসলামাবাদ যদি ক্ষোভ দেখাতে তাদের বিদেশমন্ত্রীকে না পাঠায়, তা হলে ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাকিস্তানের অনুপস্থিতি নয়াদিল্লির সামনে একটি বড় সুযোগ এনে দেবে। তাতে আরও কোণঠাসা হবে ইসলামাবাদ। স্বাভাবিক ভাবেই এ ব্যাপারে উভয় সঙ্কটে পাকিস্তান।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনও একটি সদস্য দেশ যোগ না দিলেই সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। অতীতেও এমন উদাহরণ রয়েছে। ভারত-পাক দ্বৈরথও বারবার সার্কের মঞ্চে ছায়া ফেলেছে। কিন্তু এ বার সার্কের একাধিক দেশ যে ভাবে পাকিস্তানের সন্ত্রাস ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতের পাশে থেকেছে, তা সাউথ ব্লকের নিঃশব্দ কূটনীতি ও কৌশলের ফল বলেই মনে করছেন কূটনীতিকেরা।
বাংলাদেশ, ভুটান ও আফগানিস্তান সার্ক সম্মেলন বয়কটের কারণ দেখিয়ে যে চিঠি লিখেছে, তাতে নাম না করেও সন্ত্রাসে পাকিস্তানের মদত দেওয়াকেই দায়ী করা হয়েছে। সার্কের এ বারের সভাপতি (চেয়ার) রাষ্ট্র নেপালকে ২৭ সেপ্টেম্বর কাবুলের পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে, ‘‘আফগানিস্তানের উপর সন্ত্রাসবাদ চাপিয়ে দেওয়ায় হিংসা বেড়ে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আশরাফ ঘানি এ কারণে ইসলামাবাদের সার্ক সম্মেলনে যেতে পারছেন না।’’ একই সুরে সার্ক সচিবালয়কে চিঠি দিয়েছে ঢাকা। তাতে বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ক্রমশ হস্তক্ষেপ বাড়িয়েই চলেছে একটি দেশ। নভেম্বরে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে যা আদৌ কাঙ্খিত পরিস্থিতি নয়।’ ভুটানের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, ‘‘গোটা অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বাড়াবাড়ি হচ্ছে। যা সফল ভাবে সার্ক সম্মেলন করার জন্য একটি বড় বাধা।’’
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের দাবি, সন্ত্রাস প্রশ্নে সার্কের এই দেশগুলির প্রকাশ্যে পাক-বিরোধিতা নয়াদিল্লির কাছে বিরাট বোনাস পাওয়ার সমান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই আঞ্চলিক কূটনীতিতে জোর দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সার্ককে নিছকই নখদন্তহীন একটি গোষ্ঠী থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যকরী মঞ্চ বানানোর প্রস্তাব ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে সার্কের বৈঠকে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে গোষ্ঠীভুক্ত সমস্ত দেশের মধ্যে মোটর ভেহিকেলস্ চুক্তি, আঞ্চলিক রেল সংযোগ, সন্ত্রাস-বিরোধী কাজকর্ম, বাণিজ্য করিডর গড়ে তোলা নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এগুলি যাতে দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য কাজও শুরু করেছিল ভারত।
কিন্তু পাকিস্তানের বাগড়ায় বাস্তবে কিছুই হয়ে ওঠেনি। নওয়াজ শরিফ বরাবরই জানিয়েছেন, এ সব বিষয়ে তাঁদের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। এক বছর অপেক্ষা করার পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই ভারত-ভুটান-বাংলাদেশ-নেপাল (বিবিআইএন) করিডর, চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে এড়িয়ে সরাসরি আফগানিস্তানের সঙ্গে পণ্য সংযোগ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা শুরু করে দেয় ভারত। আর দিল্লির পরবর্তী পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্কের অন্য দেশগুলির সঙ্গে মিলে ‘টেররিস্ট অফেন্স মনিটরিং ডেস্ক’ ও ‘ড্রাগ অফেন্স মনিটরিং ডেস্ক’ তৈরি করা।