এস জয়শঙ্কর
প্রসঙ্গ পাকিস্তান হলে সেই নিয়ে দৌত্যের রশি নিজের হাতেই রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত কাল তাঁর ‘হঠাৎ’ লাহৌর-যাত্রা আর এক বার এই বিষয়টিই স্পষ্ট করে দিচ্ছে। সেখানে গিয়ে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে তিনি পরিষ্কার করে এসেছেন পরবর্তী বিদেশসচিব পর্যায়ের আলোচনার পথ। ঠিক হয়েছে, ১৫ জানুয়ারি সে জন্য ইসলামাবাদ যাবেন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। সেই বৈঠকের লক্ষ্য হবে, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের আলোচনার গিঁট খোলা।
কিন্তু জেট গতির এমন দৌত্যর সঙ্গেও জুড়ে থাকছে সমালোচনা। পুরো প্রক্রিয়ার কিছুই জানত না বিদেশ মন্ত্রক। বস্তুত, গত রাতে মোদী দেশে ফেরার পর নয়াদিল্লির বিমানবন্দরে এসে দেখা করেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সেখানেই মোদী তাঁকে লাহৌর-দৌত্য সম্পর্কে সবিস্তার জানান। তার আগে পর্যন্ত এ ব্যাপারে সুষমার কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না বলেই খবর। মোদীর কাছ থেকে সব শুনে তিনি সংশ্লিষ্ট যুগ্মসচিব এবং অন্য অফিসারদের এ সম্পর্কে জানিয়েছেন। শুধু গত কালের লাহৌর যাত্রাই নয়, তিন সপ্তাহ আগে ব্যাঙ্ককে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক সম্পর্কেও বিদেশ মন্ত্রককে আগাম কিছু জানায়নি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শেষ মুহূর্তে সেখানে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসকে জানানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা নেহাতই বৈঠকের আয়োজন করার জন্য। এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা হয় মোদী নিজে নিচ্ছেন অথবা তাঁর দফতরের অফিসার এবং অজিত ডোভালের সঙ্গে পরামর্শ করেই নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। বিরোধীদের একাংশ এই নিয়ে তাই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মোদী নিজে পাকিস্তান নিয়ে অগ্রণী হোন, কিন্তু বিদেশ মন্ত্রককে কেন অন্ধকারে রাখা হবে?
আরও পড়ুন, মোদীর সফর জানা ছিল না সুষমারই
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, পাকিস্তানের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে আসলে মন্ত্রগুপ্তি বজায় রেখেই চলতে চাইছেন মোদী। এত রাখঢাক বা নাটকীয় ভাবে যাত্রাপথ বদল, সবই সে কারণে। যদিও কালকের ‘হঠাৎ সফরে’র পরে দলের সব স্তরের নেতাই তাঁকে উদ্বাহু হয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আরএসএসের প্রাক্তন সদস্য এবং এখন অমিত শাহের টিমের সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব তো কয়েক ধাপ এগিয়ে অখণ্ড ভারত (বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান) গঠনের ডাক দিয়েছেন। লালকৃষ্ণ আডবাণী পর্যন্ত বলেছেন, ‘‘দু’টি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। তা হলে সন্ত্রাসের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে।’’ অটলবিহারী বাজপেয়ী যে দৌত্য শুরু করেছিলেন, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। মোদী ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিংহ এবং কৈলাস বিজয়বর্গীয়র মতো নেতারা, যাঁরা কথায় কথায় বিরোধীদের পাকিস্তানে পাচার করার হুমকি দিতেন, তাঁরাও গত কালের দৌত্য নিয়ে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। কৈলাসের কথায়, নরেন্দ্র মোদী আজ প্রমাণ করে দিলেন ৫৬ ইঞ্চি ছাতির দম কতটা!
তবে বিরুদ্ধ স্বরও আজ একই ভাবে শোনা গিয়েছে। গত কাল প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী আনন্দ শর্মা জানিয়েছিলেন, ইসলামাবাদ ভারত-বিরোধী সন্ত্রাস দমনে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করেনি। তা সত্ত্বেও গায়ে পড়ে পাকিস্তান সফর করা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার আজ দাবি করেছেন, বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির চাপ রয়েছে মোদীর উপর। তার কাছে নতি স্বীকার করে মোদী কাল পাকিস্তান গিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পাকিস্তান যত ক্ষণ না সন্ত্রাসবাদের পথ ছাড়বে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব নয়।’’ কংগ্রেসের আর এক নেতা মণীশ তিওয়ারি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘‘মোদী নওয়াজের বাড়িতে যে খাবার খেলেন, তার দাম দেশের নিরাপত্তার বিনিময়ে না চোকাতে হয়!’’ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘মোদী প্রয়োজনে হঠাৎ লাহৌর যান, আবার হঠাৎ করে দু’দেশের কথাও বন্ধ করে দেন!’’ মোদীর ‘হঠাৎ সফর’কে আক্রমণ করেছে শরিক শিবসেনাও।
এ সব ছোটবড় সমালোচনা সত্ত্বেও একটি বিষয় স্পষ্ট— অসহিষ্ণুতা-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্কের মুখ বছরের শেষে নরেন্দ্র মোদী ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন সফল ভাবে। বিজেপি নেতারা বলছেন, বিরোধীরা যতই খুটিনাটি প্রসঙ্গ তুলে সমালোচনা করুক, তারাও জানে ওস্তাদের মার দিয়েছেন মোদী। বিদেশ মন্ত্রককে জানানো, না-জানানোর বিতর্ক তাই ধোপে টেকে না!b