মুখ ঢেকে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনে। যেমন তেমন নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিজ্ঞাপন। তা-ও আবার সিপিএমের দলীয় মুখপত্রের প্রথম পাতায়। যেখানে মোদী সরকারের দু’বছরের সাফল্যের সগর্ব ঘোষণা। এ নিয়েই গোল বেধেছে সিপিএমের অন্দর মহলে। এক দিকে দল মোদী জমানার নিন্দা করে ‘দো সাল, জনতা বেহাল’ নামের প্রচার-পুস্তিকা বার করছে। আবার তাদেরই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দলের মুখপত্রে মোদী-সরকারের দু’বছরের সাফল্য বিজ্ঞাপন কেন? এতে কি মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে না?
প্রশ্ন উঠেছে ত্রিপুরা থেকে। জবাব দিয়েছেন প্রকাশ কারাট। এবং কী আশ্চর্য! কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতাদের প্রবল সমালোচক কারাট এ বিষয়ে বাংলার পাশেই। সীতারাম ইয়েচুরির মত ছিল, এতে কোনও ভুল হয়নি। এ বার কারাটও বলেছেন, আলিমুদ্দিন এ ক্ষেত্রে কোনও ভুল করেনি।
গল্পের শুরু গত ২৬ মে। মোদী সরকারের দু’বছর পূর্তিতে প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রেই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয় পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের দলীয় মুখপত্রেই। এমন বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক নেতাই প্রশ্ন তুলেছিলেন, এর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নিজের সাফল্য গেয়ে বিজ্ঞাপন দিলেও তা দলীয় মুখপত্রে ছাপা হবে? অর্থের জন্য কি সব বিজ্ঞাপনই নিতে হবে? তা হলে আর তথাকথিত ‘বুর্জোয়া সংবাদপত্রে’র সঙ্গে দলীয় মুখপত্রের পার্থক্য কী রইল?
কেরল সিপিএম থেকেও প্রশ্ন উঠতে দেরি হয়নি। ঘটনাচক্রে, ২৫ মে কেরলে পিনারাই বিজয়ন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কেরল শাখা থেকে প্রশ্ন ওঠে, ২৬ মে কেরলের দলীয় মুখপত্রে যখন নতুন বামফ্রন্ট সরকারের যাত্রা-শুরুর ঘোষণা, সে দিন পশ্চিমবঙ্গের দলীয় মুখপত্রে মোদীর ছবি কেন?
দলের অন্দরে এই প্রশ্নটাই সরাসরি কারাটের কাছে করেছিলেন ত্রিপুরার হরিপদ দাস। আগরতলা থেকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ইংরেজি মুখপত্রে তিনি প্রশ্ন পাঠান, সিপিএম কি এ বিষয়ে কোনও নীতি মেনে চলে? কেন্দ্রীয় কমিটির ওই মুখপত্রের সম্পাদক বর্তমানে কারাট। হরিপদবাবু জানতে চান, দল নিজের প্রচারে যে কথা বলছে, তার উল্টো কথা সম্বলিত বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে কেন? নিজের মতাদর্শের বিপরীত বিজ্ঞাপন ছেপে কি দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে না?
কারাট কিন্তু এর মধ্যে ভুল দেখছেন না। তাঁর যুক্তি, এ বিষয়ে অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গিয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত হল, পার্টির প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন নেবে। কারণ দৈনিক পত্রিকা চালাতে হলে যে রাজস্ব আয় দরকার, তার বড় উৎস হল সরকারি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন ছাপা মানেই সরকারের নীতিকে সমর্থন নয়। বামেরা সব জমানাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে এসেছে। কিন্তু তা-ই বলে বিজ্ঞাপন নেওয়া বন্ধ করা যায় না। রাজ্য সরকার বা বহুজাতিক সংস্থার ক্ষেত্রেও একই নীতি বলে জানিয়ে দিয়েছেন কারাট।
একই কথা বলছেন দলের রাজ্য কমিটির তরফে বাংলা মুখপত্রের অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত অভীক দত্তও। তাঁর বক্তব্য, দলীয় মুখপত্রের বিজ্ঞাপন নীতিই ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে কারাটের জবাবে। তার বাইরে তাঁদের আর কিছু বলার নেই। তা হলে তর্কের খাতিরে এর পরে মমতার সরকারের বিজ্ঞাপনও তাঁরা নিতে পারেন? অভীকবাবু বলছেন, ‘‘কল্পিত প্রশ্নের তো কোনও জবাব হয় না! তবে সরকারি বিজ্ঞাপন সরকারেরই, কোনও দলের নয়। সরকারি বিজ্ঞাপন নেওয়ার অধিকার আমাদের আছে। ওই বিজ্ঞাপনের জন্য আমরা আদালতে পর্যন্ত লড়াই করেছি।’’ বাংলার নেতারা বলছেন, তাঁরা দলের নীতি মেনেই মোদী সরকারের বিজ্ঞাপন নিয়েছেন। কিন্তু শপথগ্রহণের দিন সকালে বিজয়ন যে ভাবে সব জাতীয় সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তা মোটেই দলের নীতি বা ঐতিহ্য মেনে হয়নি। বিজ্ঞাপনে সিপিএম বা বাম জোটের নামগন্ধও ছিল না! শুধুই বিজয়ন আর বিজয়ন! এর আগে সিপিএমের মুখপত্রে বহুজাতিক নরম পানীয় সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়ে হইচই হয়েছিল। এ বার কি তা হলে বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়েও আর বাছবিচার করবে না সিপিএম? কারাটের জবাব, তা নয়। যদি কোনও আন্দোলন চলার সময়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয় বিজ্ঞাপনে, তা হলে তা নেওয়া হবে না। বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রেও একই নীতি নেওয়া হবে। তাঁর যুক্তি, দৈনিক সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে বাছবিচার করা সম্ভব নয় ঠিকই। তবে দলের তাত্ত্বিক পত্রিকায় অনেক বেশি যাচাই করা হবে।