উত্তর নেই। বরং প্রশ্ন তুলতেই আরও গাঢ় হল রহস্য।
স্বাভাবিক। যখন লাল পাগড়ি মাথায় দিয়ে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী! এক মাস আগেও বলেছিলেন। ফের বললেন।
কী সেই বিষয়, যা চমকে দিয়েছে বিপুল ভোটে জিতে আসা প্রবল ক্ষমতাশালী নরেন্দ্র মোদীকেও? সরকার গড়ার দু’মাস পরে স্বাধীনতা দিবসে প্রথম বক্তৃতাতেও তা মেলে ধরতে হয় জনসাধারণের কাছে?
গত কাল এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতার প্রায় গোড়ার দিকেই প্রসঙ্গটা তোলেন মোদী। তাঁর বক্তব্য, দিল্লিতে তিনি ‘আউটসাইডার’ (বহিরাগত)। দিল্লির অভিজাত শ্রেণির কাছেও অচ্ছুৎ! প্রধানমন্ত্রী এখানেই থেমে গেলে তার একটা মানে করা যেত। কিন্তু লালকেল্লার মঞ্চে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি সোজাসাপটা। বললেন, নিজে ‘আউটসাইডার’ ঠিকই, কিন্তু গত দু’মাসে ‘ইনসাইডার’ হয়ে ভিতরের হাল দেখে চমকে গিয়েছেন তিনি। কেন? প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “আমার মনে হল, একটি সরকারের ভিতরেও কয়েক ডজন সরকার চলছে! প্রত্যেকের যেন নিজের নিজের জমিদারি তৈরি হয়ে রয়েছে! আমি দেখলাম সকলে ছত্রভঙ্গ, যুযুধান! এতটাই যে, এক বিভাগ অন্য বিভাগের সঙ্গে লড়াই করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চলে যায়!”
মোদীর এই বিস্ময়, প্রশ্ন নতুন নয়। সরকারের এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর মোদী নিজের ব্লগে কতকটা এই ভাষাতেই লিখেছিলেন, সরকারের মধ্যে একটি ‘সিলেক্ট গ্রুপ’ কাজ করছে। দিল্লির অলিন্দের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘পাওয়ার ব্রোকার’। শুক্রবার সেই বক্তব্যকে আরও খোলসা করে তুলে ধরলেন তিনি। কিন্তু কারা এই পাওয়ার ব্রোকার? কারা সরকারের মধ্যে আরও কয়েক ডজন সরকার তৈরি করে রেখেছেন? মোদীর মতো একজন প্রধানমন্ত্রীকেও কেনই বা বারবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতে হচ্ছে? উত্তর অবশ্য দেননি প্রশ্নকর্তা, স্বয়ং মোদী। কিন্তু তাঁর তোলা প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দিল্লির অলিন্দে। চায়ের পেয়ালায়, কফিশপের টেবিলে। এমনকী প্রশাসনের কড়িকাঠেও।
মোদীর কড়া শাসনের সামনে এমনিতেই ত্রস্ত তাঁর মন্ত্রীরা। কেউ আর মুখ খুলতে চান না। কিন্তু মোদীর তোলা প্রশ্ন তাঁদেরও ভাবাচ্ছে। এমনই এক শীর্ষ মন্ত্রীর কথায়, “কোনও দ্বিমত নেই, দিল্লিতে এমন ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেক রয়েছে। ইউপিএ-র এক দশকের জমানায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ‘ল্যান্ডমাইন’ পুঁতে রাখা হয়েছে! মোদী সেগুলিই দূর করতে চাইছেন!” মন্ত্রীদের শাসনে রাখতে গিয়ে তাঁদের সচিব নিয়োগের পদ্ধতি পর্যন্ত বদলে ফেলেছেন মোদী। এমনকী এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকেও কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক করে যাবতীয় রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু দেখেছেন, তাতেও সমস্যা মেটেনি। দেখেছেন, মন্ত্রকে-মন্ত্রকে তুমুল বিবাদ। এক মন্ত্রকের সুপারিশ খারিজ করে দেয় অন্য মন্ত্রক। এটি মূলত হয় আমলা স্তরেই। আর এর পিছনে থাকে কোনও না কোনও গোষ্ঠীর হাত। এই চাপ ঘুরপথে আসে মন্ত্রীদের উপরেও। মোদী-ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীদের অনেকেই বলছেন, সম্ভবত এই সব কথাই মোদী বারবার বলতে চাইছেন। যে কারণে এই সমস্যা থেকে বেরোনোর পথ বাতলাতে গিয়ে তিনি বারবার আমলাতন্ত্রের উপরেই খড়্গহস্ত হয়েছেন। মোদী বলেছেন, “এই ছত্রভঙ্গ অবস্থা, যুযুধান দশা কাটাতে আমি চেষ্টা শুরু করেছি। যাতে এই দেওয়াল ভেঙে একটি ইউনিট হিসেবে এক সরকারের এক লক্ষ্য, এক মন, এক দিশা, এক গতিতে কাজ করতে পারি। চাপরাশি থেকে ক্যাবিনেট সচিব সকলের মধ্যেই ক্ষমতা রয়েছে। সেই শক্তিকে জাগিয়ে দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করাই আমার লক্ষ্য।” অফিসারদের এক হাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, “নতুন সরকারে অফিসারেরা সময় মতো অফিস আসছেন, খবরে এটি শুনে সরকারের মুখিয়া হিসেবে আমি খুশি হতে পারতাম। কিন্তু এটিই যদি খবর হয়, তা হলে আমরা কতটা নীচে নেমে গিয়েছি, তার প্রমাণ হয়ে যায়।”
লালকেল্লায় প্রথম বক্তৃতায় আমলাতন্ত্রের প্রতি এমন তীক্ষ্ন আক্রমণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজেপির এক নেতা আজ বলেন, “যোজনা কমিশনকেই বিলোপ করে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে চাইতে পারেন। রাজ্যের হাতেও আরও ক্ষমতা তুলে দিতেও চান তিনি। কিন্তু কেন্দ্রে গোটা সরকারের রাশ তিনি নিজের হাতেই রাখতে চান। যেমনটি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি করতে পেরেছেন।”
বিজেপির ওই নেতা যা-ই বলুন, বাস্তব হল, মোদী এখন গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নন। আর রাজধানী দিল্লি, আমদাবাদ নয়। অভিজ্ঞরা জানেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রের রাঘব-বোয়ালরা বহু আগে থেকেই এখানে বসে রয়েছেন। মোদী তাঁদেরই শায়েস্তা করতে চান। বলা ভাল, আনুগত্যে আনতে চান। তাঁর পূর্বসূরি মনমোহন সিংহ যে কাজ করতে পারেননি, সেই ব্যবস্থা বদলে সকলকে এক সুরে বাঁধতে তিনি মরিয়া। একটি বিষয় স্পষ্ট, সে কাজে এখনও তিনি সফল হননি। তাই বারবার বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে ঘা দিচ্ছেন ব্যবস্থার মূলে। সময়ই বলবে, পোড় খাওয়া এই প্রাচীন দেওয়ালকে তিনি কতটা বদলাতে পেরেছেন।
কংগ্রেস অবশ্য মোদীর এই প্রয়াসকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি। দলের নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “মোদী নিজেকে ‘আউটসাইডার’ বলে আসলে নির্দোষ হওয়ার ভান করছেন। যাতে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারেন।”