মধ্যাহ্নভোজন আফগানিস্তানের হেরাটে। নৈশভোজ কাতারে। পরদিন খাওয়াদাওয়া সুইৎজারল্যান্ডে। তারপরের দু’দিন ওয়াশিংটন ডিসি। সব শেষে মেক্সিকো সিটি।
দীর্ঘদিন ‘গৃহবন্দি’ থাকার পরে আবার পায়ের তলায় সর্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর! আগামী ছ’দিনে পাঁচটি দেশে যাচ্ছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তাঁর অসংখ্য বিদেশ সফরের জন্য এর আগে বহুবার ঘরোয়া রাজনীতিতে তির্যক মন্তব্যের মুখে পড়তে হয়েছে মোদীকে। কিন্তু এ রকম ঝোড়ো সফর মোদীর সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ক্যালেন্ডারেও নজিরবিহীন। ফলে প্রশ্ন উঠছে, হঠাৎ এখনই এতগুলো দেশে যাওয়ার কেন দরকার পড়ল নরেন্দ্র মোদীর?
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, আলাদা আলাদা সফরে না গিয়ে একটি মাত্র উড়ানেই অনেকগুলো পাখি শিকারের কৌশল নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিনিয়োগ টানার প্রয়োজনীয়তা তো রয়েছেই। কিন্তু ভারতের সামনে এখন পাখির চোখ— পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী (এনএসজি)-তে অন্তর্ভুক্তি।
৯ জুন ভিয়েনায় বসছে দু’দিনের এনএসজি অধিবেশন। ভারত এই সংস্থাকে চিঠি লিখে ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন পাঠিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানও চায়, এনএসজি-র মধ্যে তাদের অন্তর্গত করা হোক। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ইসলামাবাদের আবেদনের প্রায় এক সপ্তাহ আগে তাদের আর্জি পাঠিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
এ ব্যাপারে অবশ্য বাদ সেধেছে বেজিং। তাদের দাবি, ৪৮ সদস্যের এই গোষ্ঠীতে ভারতের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়, কারণ ভারত ‘পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তি’তে সই করেনি। বেজিংয়ের দাবি, ভারতকে এনএসজিকে অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও এই গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দিন কয়েক আগেই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিন সফরে গিয়েছিলেন। তাদের এ-হেন আচরণে ভারত যে ক্ষুব্ধ, তা বেজিংকে স্পষ্ট বলেছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু এত সহজে চিনের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ যে গলবে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ওই সংস্থার সদস্য দেশগুলির অধিকাংশের সমর্থন পেলে শেষপর্যন্ত চিনের দেওয়াল টপকানো সম্ভব হবে।
সেই লক্ষ্যেই লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মোদী প্রশাসন। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, গত কয়েক দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে এনএসজি-র ৪৮টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। আগামী সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন মোদী। তা ছাড়া, মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ বৈঠকে বক্তৃতা দেবেন তিনি।
আজ প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘ভারতে দূষণমুক্ত শক্তির চাহিদা সমানে বাড়ছে। আমাদের পরমাণু শক্তির প্রয়োজন অপরিসীম। ঘরোয়া বাজারে যেমন পরমাণু শক্তির প্রয়োজন, তেমনই ভবিষ্যতে আমরা তা অন্যান্য দেশে রফতানিও করতে পারব।’’ এনএসজি-র সদস্য হতে পারলে পরমাণু শক্তি আমদানি-রফতানির দরজাটা ভারতের কাছে খুলে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর আসন্ন সফরে মেক্সিকো অথবা সুইৎজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন, ভারতে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের কতটা চাহিদা রয়েছে। বিদেশসচিবের কথায়, ‘‘পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী আর পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তি এক নয়। তাই দু’টোর মধ্যে গুলিয়ে ফেললে আদপেই চলবে না।’’ এনএসজি ছাড়া ঘরোয়া রাজনীতির একটি দিকও মোদীর সফরে প্রাধান্য পাবে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে সরব ছিলেন মোদী। লোকসভা ভোটের সময় বিজেপির রাজনৈতিক ইস্তেহারেও এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত দু’বছরে এ নিয়ে কিছুই করতে পারেনি মোদী সরকার। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে সংসদের বাইরে এবং ভিতরে সরকারকে আক্রমণ করেছে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল। সুইৎজারল্যান্ডে মোদীর একদিনের সফরে এই নিয়ে যে বিরাট অগ্রগতি হবে, তা হয়তো নয়। কিন্তু সে দেশের সরকারের সঙ্গে কালো টাকা ফেরানো নিয়ে যে আলোচনা হবে, তাকে দেশে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিছু দিন আগে ভারতে নিযুক্ত সুইৎজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত লাইনাস ফন কাসেলমার বলেছিলেন, এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে তা দ্রুত শেষ করা সম্ভব। এই সুযোগ তাই হাতছাড়া করতে চাননি মোদী।