বছর তিরিশেক আগেও নির্মলসিংহ ভাঙ্গুকে পঞ্জাবের রূপনগর জেলায় সাইকেলে চেপে দুধ বেচতে দেখা যেত।
ষাটের কোঠায় পৌঁছে সেই ভাঙ্গু এখন দেশ জুড়ে ১ লক্ষ ৮৩ হাজার একর জমির মালিক। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর হোটেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের নাম ব্রেট লি। দিল্লি-পঞ্জাব থেকে ব্রিসবেন-মেলবোর্নে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর আবাসন প্রকল্প। আইপিএল-ফোরে কিঙ্গস ইলেভেন পঞ্জাবের তিনিই অন্যতম স্পনসর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে টিভি চ্যানেল, পর্যটন থেকে গল্ফ প্রিমিয়ার লিগ— সব ধরনের ব্যবসাই রয়েছে ভাঙ্গু ‘পার্লস অ্যাগ্রোটেক কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর ঝুলিতে।
এই সবের উৎস একটাই। ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থা বা ‘পঞ্জি স্কিম’-এর ব্যবসা। শুক্রবার সন্ধেয় সিবিআই ভাঙ্গুকে গ্রেফতার করেছে। তাদের প্রাথমিক হিসেব, দেশ জুড়ে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের থেকে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছে ভাঙ্গুর সংস্থা। সিবিআই অফিসারদের বক্তব্য, ‘‘ভাঙ্গুর তুলনায় সারদার সুদীপ্ত সেন নেহাতই শিশু। সারদা যেখানে টেনেটুনে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল বলে হিসেব মিলেছে, সেখানে পার্লস গোষ্ঠীর অর্থ সংগ্রহের অঙ্কটা তার ১৫ গুণ। ভাঙ্গুকে সুদীপ্ত সেনদের ‘গুরু’ বললেও কিছু ভুল হবে না।’’
ভাঙ্গু গ্রেফতার হতেই জোর জল্পনা শুরু হয়েছে, এ বার কি পঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিংহ বাদলের নামও জড়াতে চলেছে সিবিআই তদন্তে?
এই জল্পনার কারণ, সুখবীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়েই গত কয়েক বছরে ভাঙ্গুর ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠেছিল বলে অভিযোগ। কংগ্রেসের অভিযোগ, এই ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ হল, ভাঙ্গুর পার্লস গোষ্ঠী গত চার বছর ধরে সুখবীরের প্রিয় কবাডি বিশ্বকাপ স্পনসর করছে। দু’মাস আগে ‘সদ্ভাবনা র্যালি’র আয়োজন করেছিলেন সুখবীর। সে-ও এই পার্লসের জমিতেই। দু’বছর আগে পার্লস গোষ্ঠীর নামে মামলা দায়ের করা হলেও এত দিন সিবিআই যে তাঁকে গ্রেফতার করেনি, তার পিছনেও সুখবীরের হাতই দেখতেন তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা।
আগামী বছরই পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে ভাঙ্গুকে হাতিয়ার করে সুখবীর তথা প্রকাশসিংহ বাদলের পরিবারকে নিশানা করতে চাইছে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি।
সুখবীবের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও সিবিআই সূত্র বলছে, পঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত কবাডি বিশ্বকাপের স্পনসর হিসেব ভাঙ্গুর সংস্থা পঞ্জাব সরকারকে ৩৫ কোটি টাকা দিয়েছিল। রাজ্য সরকারের থেকে এই লেনদেনের বিশদ তথ্য চাওয়া হয়েছে। কবাডি বিশ্বকাপ, আইপিএল-ফোরে কিঙ্গস ইলেভেন পঞ্জাবের পাশাপাশি ২০১১-য় ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সিরিজেরও স্পনসর ছিল ভাঙ্গুর সংস্থা। রাজ কুন্দ্রা ও সঞ্জয় দত্তর পরিকল্পিত সুপার ফাইট লিগ ও গল্ফ প্রিমিয়ার লিগেরও স্পনসর ছিল পার্লস। সেই সব লেনদেনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সুদীপ্ত সেন যেমন সারদা গোষ্ঠী তৈরির আগে সিলিকন প্রোজেক্টে তাঁর ‘গুরু’ শিবনারায়ণ দাসের কাছে হাত পাকিয়েছিলেন, ভাঙ্গুও তেমন কাজ শুরু করেন গোল্ড ফরেস্টস নামে একটি চিট ফান্ড সংস্থায়। তার পর ১৯৯৬-তে নিজেই পার্লস নামের সংস্থা খুলে বসেন। দিল্লির কনট প্লেসে এই সংস্থার সদর দফতর। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, টাকার বিনিময়ে জমির মালিকানার ভুয়ো শংসাপত্র তুলে দেওয়া হতো বিনিয়োগকারীদের হাতে। মোটা সুদের লোভ দেখিয়ে বোঝানো হতো, জমিতে লগ্নি হচ্ছে বলে টাকা কয়েক গুণ হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রাজস্থান সীমান্তে মরুভূমির জমির মালিকানার কাগজও দেওয়া হয়েছিল লগ্নিকারীদের। নতুন লগ্নিকারীদের থেকে টাকা তুলে পুরনো লগ্নিকারীদের মেটানো হতো। এরই পাশাপাশি রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে যেখানে শিল্প বা সরকারি প্রকল্প হবে, তার আশেপাশে সস্তায় জমি কিনতেন ভাঙ্গু। তার পর তা কয়েক গুণ দামে বেচতেন। পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট এই বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার পর অন্য নামে আর একটি সংস্থা খুলে ফেলেন ভাঙ্গু। দু’টি সংস্থার হয়ে গত ৬-৭ বছরে অন্তত ৩০ লক্ষ এজেন্ট কাজ করেছেন।
ছ’বছর আগে ভাঙ্গুর সংস্থা যখন ৬.২ কোটি ডলার দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে শেরাটন মিরাজ রিসর্ট কেনে, তখন অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল। সিবিআই সূত্রের খবর, ওই হোটেল নতুন করে সাজানোর জন্য আরও ৩ কোটি ডলার খরচ করেন ভাঙ্গু। সিবিআই তদন্ত বলছে, এ দেশের মানুষকে বেকুব বানিয়ে তোলা টাকা থেকে প্রায় ১৩৩ কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার ভাঙ্গুর অস্ট্রেলিয়ার সংস্থায় সরিয়ে ফেলা হয়। সেই টাকাতেই হোটেল, মেলবোর্ন-ব্রিসবেনে আবাসন প্রকল্প তৈরি করছিলেন এক সময়ের এই দুধওয়ালা। ভাঙ্গুর সঙ্গে তাঁর সংস্থার চার শীর্ষ-কর্তাকেও গ্রেফতার করেছে সিবিআই। দিল্লির কনট প্লেসে পার্লসের সদর দফতরে হানা দিয়ে হাজার খানেক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে।