ত্রাতা সল্টলেকের অটোচালক

ঘরে ফিরছে মেঘালয়ের হারানো ছেলে

সল্টলেকের সেক্টর-ফাইভের অফিসপাড়া চক্কর দিয়ে বেড়াত ময়লা পোশাকের ছেলেটা।মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ। কারও কথাতেই তেমন সাড়া দিত না। খিদে পেলে শুধু ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে খাবার চাইত। হাতে একটা পেন। সেটা নিয়েই এখানে-ওখানে হিজিবিজি। নাম লিখতে বললে লিখত, ‘সিলিয়ন সাংমা’।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৭
Share:

মেঘালয় থেকে আসা উদ্ধারকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন সিলিয়ান। নিজস্ব চিত্র

সল্টলেকের সেক্টর-ফাইভের অফিসপাড়া চক্কর দিয়ে বেড়াত ময়লা পোশাকের ছেলেটা।

Advertisement

মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ। কারও কথাতেই তেমন সাড়া দিত না। খিদে পেলে শুধু ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে খাবার চাইত। হাতে একটা পেন। সেটা নিয়েই এখানে-ওখানে হিজিবিজি। নাম লিখতে বললে লিখত, ‘সিলিয়ন সাংমা’। আর কিচ্ছু না। আসলে, মাথাটাই আর ঠিক ছিল না ওর।

চার বছর ধরে ওকে এ ভাবেই দেখেছেন গোলকবাবু। গোলক মণ্ডল। করুণাময়ী থেকে সেক্টর-ফাইভের এসডিএফ রুটে অটো চালান বেলেঘাটার এই বাসিন্দা। বেশ কিছু দিন হল, উত্তর-পূর্বের পাহাড় পেরিয়ে শুভেচ্ছা-বার্তা এসেছে গোলকবাবুর জন্য। আশ্চর্য কী! তিনি না থাকলে কি মেঘালয়ের রংগ্রামে নিজের ‘ভুলে যাওয়া’ ঘরবাড়ি, মায়ের আদর আর ফিরে পেত সিলিয়ান?

Advertisement

‘পেত’ নয়, ‘পেতেন’ বলাই ভাল। সিলিয়ান সাংমা। বয়স ২৫। ২০১২-য় ঘর ছেড়েছিলেন চাকরির খোঁজে। আর পাত্তা ছিল না। এ সবই জানা গিয়েছে কাটা ‘সুতোটা’ জোড়া লাগার পর।

গোলকবাবু বলছিলেন, ‘‘আমাদের স্ট্যান্ডে ওকে মাঝে মাঝেই দেখতাম। রেলিংয়ে লাগানো ফ্লেক্সগুলোয় আপন মনে পেন দিয়ে কী সব লিখত। অটোওয়ালারা অনেকেই ওকে খ্যাপাত। ও রেগে যেত। বড় বড় নখ দিয়ে খামচে দিত।’’ কিন্তু গোলকবাবু সে সব করেননি কখনও। বরং প্রায়ই চা-বিস্কুট খাওয়াতেন সিলিয়ানকে। কখনও কখনও স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো অটোয় এসে বসতেন সিলিয়ান। কথা বিশেষ হতো না। তবে নাম লিখতে বললে লিখতেন।

এক দিন চা খেতে খেতেই গোলকবাবু সিলিয়ানকে বলেছিলেন, ‘‘এই কাগজে তোমার ঠিকানা লেখ।’’ কী ভেবে সিলিয়ান সে দিন ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখেন, ‘বিলিয়ান সাংমা, মেঘালয়।’ পরে একটা ফোন নম্বর। গোলকবাবুর কথায়, ‘‘সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। ফোনের ও-পারে বিলিয়ান, ওঁর দাদা। হিন্দিতে সিলিয়ানের কথা ওঁকে বললাম। ওঁদের সঙ্গে কথাও বলিয়ে দিলাম।’’

অটোচালক গোলক মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র

ওই একটা ফোনই মেঘালয়ের পশ্চিম গারো হিলের সঙ্গে সেতু বেঁধে দেয় সল্টলেকের। সিলিয়ানকে ফিরিয়ে আনতে মেঘালয়ের সমাজকর্মী সোসন এ সাংমার সাহায্য চায় তাঁর পরিবার। সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চলতে থাকে ‘সিলিয়ান উদ্ধার অভিযান’। অনলাইনেই যোগাযোগ হয় কলকাতায় থাকা গারোদের সঙ্গে। মেঘালয়ের তুরার বাসিন্দা সুপ্রতিম সিংহ থাকেন কলকাতায়। তিনি সেক্টর-ফাইভে গিয়ে সিলিয়ানের ছবি তুলে ‘পোস্ট’ করেন। সেই ছবি দেখেই নিশ্চিত ভাবে ছেলেকে চিনতে পারেন বাড়ির লোকেরা। এর পর গত ১৮ জানুয়ারি সিলিয়ানের পরিবারের দুই সদস্যকে নিয়ে মেঘালয় থেকে কলকাতা পৌঁছয় চার জনের একটি দল। বিধাননগর পুলিশকে সব জানিয়ে, সিলিয়ানকে কলকাতার মেঘালয় হাউসে নিয়ে যান তাঁরা। ডাক্তার দেখানো হয় সেখানেই।

ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয় তাঁর হারিয়ে যাওয়ার গোটা গল্পটা। সিলিয়ান নিখোঁজ ছিলেন ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে। চেনা এক ব্যক্তি চাকরির আশ্বাস দিয়ে চেন্নাইয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু চাকরিটা হয়নি। হতাশ সিলিয়ান গুয়াহাটিমুখী ট্রেনে চেপে বসেছিলেন। সেই ট্রেনেই পড়ে যান কেপমারের খপ্পরে। সহযাত্রীর ভেক ধরে তাঁকে মাদক-মেশানো খাবার খাইয়ে দেয় তারা। জ্ঞান ফিরলে সিলিয়ান নিজেকে দেখতে পান কলকাতার এক স্টেশনে। সঙ্গে টাকাকড়ি, ব্যাগপত্র— কিচ্ছু নেই। ইংরেজি সামান্য বোঝেন, বলতে পারেন না। হিন্দিও ভাঙা ভাঙা। একে নিঃস্ব, তার ওপর কড়া মাদকের প্রভাব, অচেনা শহরের আতঙ্ক, খিদে— প্রবল চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন সিলিয়ান। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছন সেক্টর-ফাইভে। ঠিকানা হয় ফুটপাথ। গোলকবাবুর কথায়, ‘‘গোটা সেক্টর-ফাইভ চক্কর মেরে বেড়াত। সবাই ওর মুখ চিনত।’’

কলকাতার ডাক্তারবাবু সিলিয়ানের উদ্ধারকারীদের বলে দিয়েছেন, ওঁর মাথায় যেন আর বেশি চাপ না পড়ে। আগামী সোমবারের বিমানেই সিলিয়ানকে নিয়ে তাঁদের শিলং পৌঁছনোর কথা। সেখান থেকে গাড়িতে রংগ্রাম। যেখানে ছেলের পথ চেয়ে বসে মা, নেডিলা এ সাংমা। আগে ফোনে কথা হয়েছে দু’জনের। মা বলছেন, ‘‘ছেলেকে ফের দেখতে পাব, ভাবতেই পারছি না!’’

তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন কলকাতার ‘বন্ধুটিকে’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement