সুরিনামের রাষ্ট্রদূত আশনা
ওই ভোঁ বাজল জাহাজের। কালো ধোঁয়া উগরে সরে যাচ্ছে ঘাট থেকে। ঠাসাঠাসি করে ওই জাহাজে যাদের ভরে দেওয়া হয়েছে সেই গরিবগুর্বো লোকগুলো জানে, পাঁচ বছর পরে আবার তাদের দেশে ফিরিয়ে আনবে ব্রিটিশ সরকার।
আসলে আর কোনও দিনই ফেরেনি ওরা। কলকাতার হুগলি নদীর এক ঘাট থেকে জাহাজে ওঠাটাই ছিল জন্মের মতো দেশ-ছাড়া হওয়া।
নভেম্বরের হিমেল হাওয়ায় সেই নদী-বন্দরের ঘাটে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। হাসছেন, নানা কথা বলছেন। কিন্তু মনের মধ্যে কি বইছে ঝড়? ভেসে উঠছে না সেই ধোঁয়া-ছাড়া জাহাজের সাদা-কালো ফ্ল্যাশব্যাক? ১৪৫ বছর আগে ওই জাহাজে তাঁর পূর্বপুরুষও তো ছিলেন। আরও বহু মানুষের সঙ্গে তাঁকেও তো ‘চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক’ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাচার করে দিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার এক ডাচ উপনিবেশে। ছোট্ট সেই দেশের নাম— সুরিনাম।
তরুণীর নাম আশনা কানহাই। সুরিনামেই তাঁর পাঁচ পুরুষের বাস। এ বার দেশ তাঁকে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে পাঠিয়েছে গুরুদায়িত্ব দিয়ে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ— এই তিন দেশেই সুরিনামের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন আশনা। শনিবার অনেকটা সময় যাঁর কাটল কলকাতার ‘সুরিনাম ঘাটে’।
কলকাতা বন্দরে বহু বছর ধরেই রয়েছে ‘সুরিনাম ঘাট’। এ সেই ঘাট— যেখান থেকে ১৮৭৩ সালে ‘লাল্লা রুখ’ নামে একটি জাহাজে করে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বহু মানুষকে ‘চুক্তি-শ্রমিক’ হিসেবে সুরিনামে পাঠিয়েছিল ইংরেজরা। ইতিহাস বলে, দফায় দফায় আরও ৬৩টি জাহাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাঠানো শ্রমিকদের নিয়ে গিয়েছিল সুরিনামে। দেশ আর ফিরিয়ে না নেওয়ায় এই মানুষগুলোর অধিকাংশই কাজ নিয়েছিলেন সুরিনামের আখের খেতে। ক্রমশ এ ভাবেই পায়ের তলায় মাটি, তার পর শেকড়।
শনিবার সুরিনাম ঘাটে সেই মানুষগুলোকে স্মরণ করেই একটি স্মৃতিফলকের উদ্বোধন করলেন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর। সেই অনুষ্ঠানেই সারা ক্ষণ ছটফট করতে দেখা গেল রাষ্ট্রদূত আশনাকে। হাতজো়ড় করে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে শুরু করে ভোজপুরিতে কথা বলা। এমনকী বাঙালি দেখে বলে উঠেছেন, ‘‘কী ভাল!’’ এমন দু-তিনটে বাংলা শব্দ তো জানেনই, একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতও তাঁর জানা। এ দিনের অনুষ্ঠানে সুরিনামের এক শিল্পীর গলায় শোনানো হয়েছে কবিগুরুর সেই গান— ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে..।’ আর ছিল দেশছাড়া মানুষগুলোর যন্ত্রণার গান। ভোজপুরিতে সেই গান যিনি রচনা করেছেন এবং গেয়েছেন, তাঁর নাম রাজ মোহন। তাঁর পূর্বপুরুষকেও একই ভাবে কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল সুরিনামে।
আশনা জানালেন, সুরিনামে এখন প্রায় ১৭ লক্ষ হিন্দিভাষীর বাস। অনেকেই দিব্যি ভোজপুরি বলেন। সুরিনামের অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তাঁদের অবদান যথেষ্ট। আর আশনার পদবিটার সঙ্গে তো এ শহরের যোগ বহুদিনের। প্রায় আধ শতক আগে এক ‘ক্যারিবিয়ান কানহাই’কে প্রবল ভালবেসেছিল এই শহর। ইডেনে আজও উজ্জ্বল তাঁর ডাবল সেঞ্চুরি। রোহন কানহাই।
আকবর বললেন, ‘‘চুক্তি-শ্রমিক নয়, ক্রীতদাস হিসেবেই ইংরেজরা এই মানুষগুলোকে জাহাজে করে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুরিনামে।’’ এ দিন নিজের অনেক কথা বলছিলেন আশনা। বললেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের সুরিনামে পাঠানোর আগে রাখা হয়েছিল কলকাতার ভবানীপুরের একটি বাড়িতে। সেটাকে বলা হতো ‘ভবানীপুর ডিপো’। শ্রমিকদের বাইরে পাঠানোর আগে এই রকম ডিপোতে রাখত ইংরেজরা। জাহাজে তোলার আগে ছেলেদের দেওয়া হয়েছিল একজোড়া ধুতি, মেয়েদের একজোড়া শাড়ি। প্রথম সাগর পাড়ি দেবেন বলে কেউ কেউ বুকে আঁকড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হনুমান চালিসা। সে সব ঐতিহ্য সঙ্গী আজও।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ভাবছেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে ‘সুরিনাম ঘাট’ খুলে দেবেন সর্বসাধারণের জন্য। যে ঘাটের কাছে আজও অনেক গল্প বলে নদীর জল!