মাটিয়ার নির্মীয়মাণ ডিটেনশন সেন্টারে সরোজিনী হাজং। নিজস্ব চিত্র
পরম মমতায় কখনও ভিতের বুকে, কখনও বা নিজের ঘাম ঝরিয়ে তৈরি দেওয়ালে হাত বোলান সরোজিনী। কখনও লাথি মারেন আক্রোশে। নিজের হাতে নিজের জেলখানা তিলে তিলে তৈরি করছেন যে! সইতে পারা মুখের কথা নয়।
পিছনে বইছে দুধনৈ-কৃষ্ণাই নদী। সামনে রাবার খেত। চারপাশে সবুজ গালিচা পার করে দূরে পাহাড়ের সারি। মাঝখানে বিশ বিঘা জমি জুড়ে গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় দলগোমা গ্রামে তৈরি হচ্ছে ভারতের প্রথম অ-নাগরিক আটক কেন্দ্র (ডিটেনশন সেন্টার)। কাজ চলছে জোরকদমে। আর কাজ করছেন যাঁরা, গোয়ালপাড়া, ধুবুড়ি, বরপেটা থেকে আসা সেই ৪৫০ জন শ্রমিকের মধ্যে এনআরসি-ছুট অনেকে। অধিকাংশই মহিলা।
সরোজিনী হাজং ২ নম্বর রেফিউজি গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িতে এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী গৌরাঙ্গের মানসিক সমস্যা। বাড়িতে পাঁচটা পেট চলছে জেল তৈরির দিন-হাজিরা বাবদ পাওয়া ২৫০ টাকায়। অবিভক্ত রংপুর-গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা হাজং, ডালু, গারো, বনাই, কোচ, বাঙালিরা ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে ঢোকার পরে তাঁদের গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় এই সব গ্রামে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। গড়ে ওঠে ন’টি রেফিউজি গ্রাম। এখনও সেই নম্বর দিয়েই গ্রামগুলোর পরিচয়। বাসিন্দা হাজার বিশেক। সকলকে দেওয়া হয়েছিল ‘রেফিউজি এনরোলমেন্ট’ (আরই) শংসাপত্র। এনআরসি করতে সেই ‘আরই সার্টিফিকেট’ জমা দিয়েছিলেন এখানকার বাসিন্দারা। অবাক কাণ্ড! ছেলেদের নাম ঢুকলেও অনেক পরিবারেই বাদ পড়েছেন মহিলারা।
নয়নতারা হাজং বলেন, “এখানে সবাই মজা করে মেয়েদের নিয়ে। বলে, ‘নিজেদের জেল নিজেরাই বানাচ্ছিস। ভাল করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিস।’ গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমি তো এনআরসিতে নাম এসেছে কি না, দেখিইনি। পাত্তা দিই না আর। যা হবে হোক।”
মোট ১৫টা ব্লকে ২০০ জন করে ৩০০০ ‘বিদেশি’কে ঠাঁই দেবে এই অ-নাগরিক আটক কেন্দ্র। খরচ বরাদ্দ ৪৫ কোটি। এখন অসমে যে হাজার জন আটক, তাঁরা আদতে থাকেন জেলা কারাগারেরই একটি অংশে। এ নিয়ে অনেক অভিযোগ। মানবাধিকার ভঙ্গের মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। তবে দলগোমার কেন্দ্র শুধুই ঘোষিত বিদেশিদের জন্য। ভিতরে থাকছে প্রাথমিক স্কুল, হাসপাতাল, রান্না ও খাবার ঘর, বিনোদন কক্ষ। এমন আরও ১০টি কেন্দ্র তৈরি হওয়ার কথা।
রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা, আপাতত অন্য কারাগার থেকে হাজার জনকে এখানে আনা হবে। এনআরসি-ছুট ১৯ লক্ষের মামলা চলবে আরও অন্তত ৮ মাস। তত দিনে আরও কেন্দ্র তৈরি হয়ে যাবে।
অসম পুলিশ হাউজিং বোর্ডের তৈরি এই কেন্দ্রের চিফ ইঞ্জিনিয়ার রবীন্দ্র দাস অবশ্য জানান, নাগাড়ে বৃষ্টি, বড় নির্মাণ সামগ্রী আনার মতো রাস্তার অভাবের ফলে কাজের গতি বাড়েনি। অগস্টে এই কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ হয়েছে ৬৫ শতাংশ। মেয়েদের অংশে ভিতই তৈরি হয়নি। ডিসেম্বরের আগে এখানে বন্দি রাখার ব্যবস্থা করা যাবে না। তাঁর কথায়, “গুয়াহাটিতে থাকা কর্তারা বিশ্বাস করতে চান না গোয়ালপাড়ায় এত বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে নিয়ম করে জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরে গিয়ে বৃষ্টির রিপোর্ট পাঠাই।”
আর বৃষ্টিভেজা সরোজিনী মাথা থেকে বালি ভরা ডোঙা নামিয়ে বলেন, “যদি শেষ পর্যন্ত ঘর ভেঙে জেলেই পাঠাবে, তা হলে আশ্রয় দিয়েছিল কেন? জেলে থাকতেও আপত্তি নেই। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে! বার বার শুনানিতে গিয়েছি। ওরা বলল, চিন্তা নেই। তা-ও শেষে নাম বাদই দিল। এখানে দিন হাজিরা বাদ দিয়ে আমার পক্ষে একা গোয়ালপাড়ায় ফরেনার্স ট্রাইবুনালে যাওয়া, মামলা করা, উকিল ধরা সম্ভব?”