মোদী সরকারের অর্থ ও বিদেশ নীতি নিয়ে দিন কয়েক আগেই সুর চড়িয়েছিলেন। আর আজ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে তোপ দাগলেন অর্থনীতির শিক্ষক তথা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বললেন, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারের ‘কারিগরি’তে আন্তর্জাতিক মহলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ভারত!
লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পর আজ প্রথম কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক করেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। যে বৈঠকের উদ্দেশ্যই ছিল সরকারের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে বিরোধিতার দিশা স্থির করা। সনিয়া-রাহুলের পাশাপাশি সেখানে মোদী-জেটলির অর্থনীতির সমালোচনা প্রশ্নে সুর চড়িয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও। সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রস্ত কড়া সমালোচনার পর পরই মোদীর চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন মনমোহন। তবে আজকের বৈঠকে মনমোহনের দ্বিতীয় প্রস্ত গর্জনে স্বভাবতই সরগরম রাজধানীর রাজনীতি।
আজ মনমোহন বলেন, ‘‘আমি মেনে নিচ্ছি, আমার উত্তরসূরি ভাল সেলসম্যান, ইভেন্ট ম্যানেজার এবং বলিয়ে কইয়ে। প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী যাই বলুন না কেন, আমাদের (ভারতের) বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই এখন সন্দেহ তৈরি হয়েছে।’’ মনমোহন আরও দাবি করেন, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়েও এখন ‘কারিগরি’ করছে সরকার। প্রকৃত বৃদ্ধির তুলনায় বাড়িয়ে চড়িয়ে দেখানো হচ্ছে সংখ্যা। আর তাতেই আন্তর্জাতিক মহলে মুখ পুড়ছে দেশের। তাঁর কথায়, ‘‘গড় জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার গত বছর থেকে বাড়তে শুরু করেছে বলে উচ্ছ্বসিত সরকার। কিন্তু সেই পরিসংখ্যান নিয়েই সরকারের অন্দরে-বাইরে প্রশ্ন উঠছে।’’ মনমোহনের ইঙ্গিত, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্বশাসনে হস্তক্ষেপ করেই খেলছে সরকার!
সরকারের বিরুদ্ধে মনমোহনের ধারাবাহিক সমালোচনা ও কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী-বৈঠকে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে পরিষ্কার যে, রাজনৈতিক ভাবে মনমোহনকে ব্যবহার করতে চাইছেন সনিয়া। অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে মনমোহনের খ্যাতি ও মর্যাদা দুই-ই যে রয়েছে, তা বিলক্ষণ জানেন সনিয়া। অর্থনীতির প্রশ্নে মোদী সরকারকে চাপে রাখতে মনমোহনের থেকে ভাল অস্ত্র আর কে-ই বা হতে পারেন?
সরকারের বিরোধিতায় কংগ্রেসের অন্য কয়েকটি রণনীতিও ঠিক হয়েছে বৈঠকে। ঠিক হয়েছে, প্রথমত, জমি আইন সংশোধন বিল ও পণ্য পরিষেবা কর বিলের স্বরূপ নিয়ে আপত্তি জানাবে কংগ্রেস। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করবে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি। তৃতীয়ত, বঞ্চনার অভিযোগ তুলবে উত্তর-পূর্বের পাঁচ কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী। চতুর্থত, বর্ষা বা খরা পরিস্থিতিতে আর্থিক প্যাকেজ চাইবে কংগ্রেসের ৯টি রাজ্য। বৈঠকে সনিয়া বলেন, ‘‘লোকসভা ভোট থেকে কংগ্রেসের শিক্ষা নেওয়া উচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি বদলেছে। ভাল কাজ করলেও কোনও লাভ হবে না, যদি না আমরা আমাদের বিপণন ও প্রচার কৌশল আরও উন্নত করতে পারি। অসম ও কেরলে ভোটের আগে প্রচারের কাজ রূপায়ণ করতে হবে সেখানকার সরকারকে।’’
এই রণনীতি প্রণয়নে কংগ্রেসের যুক্তি কী হবে তা-ও বৈঠকে ব্যাখ্যা করেন মনমোহন। তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে। তা থেকে পালানো যায় না। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু কল্যাণ সব ক্ষেত্রেই বাজেটে বিপুল বরাদ্দ ছাঁটা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার এই ক্ষেত্রগুলিতে কেন্দ্র কত বরাদ্দ ও খরচ করেছে সে ব্যাপারে কংগ্রেসের উচিত সরকারের কাছে শ্বেতপত্র চাওয়া।’’ আবার পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘অতীতে কংগ্রেস সরকার যখন এই নীতি প্রস্তাব করে তখন আপত্তি করেছিল বিজেপিই। তবে বিলের পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে সংশয় রয়েছে। ১ শতাংশ লেভি বসানোর যে প্রস্তাব করা হচ্ছে তাও জটিলতা বাড়াবে।’’
কংগ্রেসের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগের জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আজ ব্লগে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। গত অর্থ কমিশনের সুপারিশের তুলনায় মোদী জমানায় চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের জেরে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি কত অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় অনুদান পাবে সেই হিসাব দেখিয়েছেন জেটলি। তরুণ গগৈ, সিদ্দারামাইয়ার মতো কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের পাল্টা বক্তব্য, এই ছুতোয় ১৫টি কেন্দ্রের অনুদানে চলা প্রকল্প রাজ্যের কাঁধে চাপাচ্ছে মোদী সরকার।
মুখ্যমন্ত্রীদের ওই বক্তব্যের প্রক্ষিতে রাহুল গাঁধী বলেন, ‘‘সরকার এক হাতে টাকা দিচ্ছে, অন্য হাতে নিয়েও নিচ্ছে।’’ মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারকে রাহুলের কটাক্ষ, ‘‘ওই সিংহের তো শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না!’’ বিরোধী সিংহ অবশ্য গর্জাচ্ছেন বটে।