এক মঞ্চে। বিহারে নয়া সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে অরবিন্দ কেজরীবাল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও লালু প্রসাদ। শুক্রবার পটনার গাঁধী ময়দানে। ছবি-পিটিআই
ঠিক ছিল মৌর্য হোটেল থেকে গাড়িতে করে গাঁধী ময়দানে আসবেন। কিন্তু অরবিন্দ কেজরীবালের সঙ্গে বৈঠক করতে করতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলেন, হেঁটেই যাবেন এটুকু পথ। রাজি হয়ে গেলেন কেজরীবালও। দু’জনে মিলে এর পর পয়দল রওনা হলেন নীতীশ কুমারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিকে।
গাঁধী ময়দানে শপথ পর্ব শেষ হতেই নীতীশের এক নম্বর অ্যানে মার্গের বাড়িতে চা-চক্র। পৌঁছে গিয়েছেন রাহুল গাঁধীও। রাহুল রয়েছেন বলেই হয়তো গরহাজির কেজরীবাল। তবে মমতার এ সবে কোনও সমস্যা নেই। মমতাকে দেখে রাহুল নিজেই উঠে এলেন। একসঙ্গে বসে অনেকক্ষণ কথা হল দু’জনের। অনেক দিন পর একান্ত আলাপচারিতা। কী হল, তা জানা গেল না। কিন্তু নীতীশ যখন মমতাকে কিছু খেতে অনুরোধ করলেন, কিছু না খেলে অন্তত ডাবের জল কিংবা ডায়েট কোক, তখন পাশে বসে থাকা রাহুল বললেন, আপনি (মমতা) শরীরের প্রতি যত্ন নিন। অন্তত ডাবের জল নিন। নীতীশ বললেন, মাঝখানে উনি পরিশ্রম করে আর হাঁটাহাঁটি করে আরও রোগা হয়ে গিয়েছিলেন। এখন সেই তুলনায় ভাল। মমতা বললেন, রাহুলকে বরং ডায়েট কোক দিন। ও ডায়েট কোক খায়। রাহুল জোরে হেসে উঠে বললেন, এখন ছেড়ে দিয়েছি।
পড়ুন: কঠিন সময়ে তেজ দেখিয়েই উঁচু পদে তেজস্বী
বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। কিন্তু আবার নিছক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও নয়। মোদী-বিরোধী হাওয়াতেই পটনায় নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদের কাছে পৌঁছেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরিরা। এসেছিলেন অরবিন্দ কেজরীবালও, যিনি দু’বছর আগে লালুর দুর্নীতি নিয়ে প্রচারে-টুইটারে সরব ছিলেন। এমন নয় যে এখনই সবাই মিলে কোনও ফ্রন্ট তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা উস্কে দিচ্ছেন সকলেই। ঘরোয়া রসিকতায় বারবার আজ তারই প্রকাশ। সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনের আগে মোদী সরকারের বিরোধিতায় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় কী করে বাড়ানো যায়, তাই নিয়েও কথা বলেছেন নেতারা।
খোশমেজাজে মমতা-রাহুল। শুক্রবার পটনায়। — নিজস্ব চিত্র
আজ মমতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিহারের মহাজোটের পর এ বার কি জাতীয় রাজনীতিতেও কোনও ফ্রন্ট তৈরি হতে চলেছে? তৃণমূল নেত্রীর জবাব, মানুষের ফ্রন্ট তৈরি হচ্ছে। হোটেলের জানলা দিয়ে গত রাতে গাঁধী ময়দানের আলোর প্রদর্শনী দেখছিলেন মমতা। কাছেই তো, হোটেল থেকে দূর নয় জায়গাটা। সেই গাঁধী ময়দান, যেখানে জয়প্রকাশ নারায়ণের ঐতিহাসিক ক্রান্তি র্যালি হয়েছিল। আর মৌর্য হোটেলটাও যেন এখন একটা চরিত্র! পাটলিপুত্রের রাজনীতির স্নায়ুকেন্দ্র এখন এটাই। এখানেই সকালে মমতার সঙ্গে দেখা করলেন ডিএমকের শীর্ষ নেতা করুণানিধির পুত্র স্ট্যালিন ও দলের অন্য নেতা টি আর বালু। বেলা ১১টায় সেই বৈঠকের পরে, দুপুর ১টায় এলেন কেজরীবাল। তাঁদের বৈঠকে ফের এসে যোগ দিলেন স্ট্যালিন ও বালু। এই হোটেলেই উঠেছেন সীতারাম ইয়েচুরি, পিতা-পুত্র ফারুক ও ওমর আবদুল্লা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার মতো নেতারাও। সকলেই গাড়ি করে গাঁধী ময়দানে গেলেন। কিন্তু একমাত্র মমতা ও কেজরীবাল পৌঁছলেন হেঁটে। আচমকা যে সিদ্ধান্তে কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীও।
পড়ুন: শপথে আবেগে ভাসল গাঁধী ময়দান
কুয়াশার জন্য সময়মতো বিমান নামতে না পারায় শপথের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল রাহুলের। কিন্তু তিনি বিকেলে নীতীশের বাড়িতে চা-চক্রে যোগ দিতে ভুল করেননি। রাহুলের জন্য শহর জুড়ে কংগ্রেস নেতারা তাঁর ছবি লাগিয়েছেন। বিহারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা সি পি জোশীও হাজির ছিলেন। এসেছিলেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেও।
রাহুলকে দেখেই মমতা জানতে চান, দেরি হল কেন? রাহুল জানান, বিমান তাঁকে নিয়ে আকাশে চরকি কাটছিল। মা আসেননি কেন, তা-ও জানতে চান মমতা। রাহুল অবশ্য উত্তর দেননি।
মমতাই নীতীশকে শপথগ্রহণের পর চা-চক্রের আয়োজনের কথা বলেছিলেন। এ জন্য এক নম্বর অ্যানে মার্গে নীতীশের বাড়ির লন সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। ছিল আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবারই। লালু বললেন, এই বাড়ির সব কিছুই তাঁর চেনা। তিনি এখানে ১৫ বছর কাটিয়েছেন। চা-চক্রের পরে নীতীশের বাড়ি থেকে ফের হেঁটে দশ নম্বর সার্কুলার রোডে লালু-রাবড়ীর বাড়িতে চললেন মমতা। সঙ্গে ফিরহাদ হাকিম। লালু-রাবড়ী, লালুর দুই ছেলে তেজস্বী-তেজপ্রতাপ তো আছেনই। লালু-রাবড়ীর বাড়িতেও তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের মধ্যে মমতাকে নিয়ে হুল্লোড় চলল। মমতাকে মাঝখানে বসিয়ে ছবিও তুললেন সকলে।
পড়ুন: নিজস্বী তুলেও লালু-কাঁটাই চিন্তা নীতীশের
তবে আজ পটনায় এত কিছুর মধ্যে অনুপস্থিত রইলেন মুলায়ম আর অখিলেশ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু এসেছিলেন। বিহারের বিজেপি নেতা সুশীল মোদীও বাদ যাননি। ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরিও। তাঁর সঙ্গে অবশ্য মমতার কথা হয়নি। কেউ মজা করে বললেন, অনুপস্থিত তা হলে শুধু নরেন্দ্র মোদী ও মুলায়ম সিংহ যাদব!
কলকাতা ফিরে যেতে পটনা বিমানবন্দরে পৌঁছেও অপেক্ষা করে ছিল চমক। সিকিউরিটি চেকের পর বিমানবন্দরের টারম্যাকে হাঁটছিলেন মমতা। পাশেই একটি প্রাইভেট বিমান ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ ডাক এল, ‘মমতাজি, মমতাজি’। রাহুল বিমানের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মমতাকে দেখে ফের নেমে এসেছেন। জানালেন, দিল্লি যাচ্ছেন। তবে খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে!