সনিয়া গাঁধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তৃণমূল নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইউপিএ ছেড়ে আসা মমতা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দিল্লি যাচ্ছেন রবিবার, ১৬ তারিখ। ১৭ এবং ১৮ তারিখ নেহরু স্মরণে সম্মেলনের আয়োজন করেছে কংগ্রেস। যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে ১৭ তারিখ রাতে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল মমতার। কিন্তু আজ সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল তাঁকে ফোন করে ১৭ তারিখের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানান। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দিল্লি যাত্রা এক দিন এগিয়ে নিয়েছেন মমতা।
লোকসভা ভোটের পরে রাজ্যে যখন ক্রমশ বিজেপির উত্থান হচ্ছে, তখন সনিয়ার ডাকে মমতার সাড়া দেওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেক রাজনীতিক। তাঁদের মতে, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফের কংগ্রেসের হাত ধরতেই হবে মমতাকে। নেহরুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা সলতে পাকানো।
মমতা নিজে অবশ্য দাবি করছেন, নেহরুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ঠিক হবে না। কিন্তু বিজেপি-জুজু যে তাঁকে তাড়া করে ফিরছে সেই ইঙ্গিত দিয়ে একই সঙ্গে তিনি বলছেন, “দেশে যখন সাম্প্রদায়িক একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে, তখন সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করা একান্ত প্রয়োজন। আর সেই কাজটা যদি নেহরুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে করা হয়, তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে!”
কিন্তু মমতা যখন কংগ্রেসের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন, তখন প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ আবার বিধানসভা ভোটে বামেদের সঙ্গে জোট গড়ার দাবিতে সরব। সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই বামেদের সঙ্গে সমঝোতা তথা সরকার-বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করে দিতে চান তাঁরা।
এই দাবি নিয়ে মঙ্গলবার কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। বুধবার তিনি সনিয়ার সঙ্গে দেখা করে লিখিত আকারে ওই প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, দলের অধিকাংশ নেতাই এখন বামেদের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী। খোদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও এ ব্যাপারে আপত্তি নেই। তবে এ দিন প্রকাশ্যে তিনি বলেন, “আপাতত রাজ্যে কংগ্রেসের শক্তি বাড়ানোই আমার লক্ষ্য। জোটের বিষয়ে পরে ভাবা যাবে।” অন্য দিকে, প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “বামেদের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব অবশ্যই রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধীই নেবেন।”
ঘটনা হল, একদা বামেদের জলস্পর্শ করতে না-চাওয়া মমতাও রাজ্যে বিজেপির উত্থানের পরে আর তাদের সম্পর্কে ততটা অনমনীয় নন। বস্তুত, লোকসভা ভোটের পরে বিমান বসুদের নবান্নে ফিশ ফ্রাই, কফিতে আপ্যায়ন করার পাশাপাশি এক সাক্ষাৎকারে বামেদের সঙ্গে তৃণমূলের সমঝোতার সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন তিনি। সে দিন মমতার বক্তব্য ছিল, “বামেরা চাইলে সমঝোতা নিয়ে কথা হতেই পারে।” আর এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের বাম-ঝোঁকের কথা শুনে কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি। মমতার মন্তব্য, “ওঁরা নির্বাচনী জোটের কথাবলছেন। আর আমরা বলছি সাম্প্রদায়িকতার বিপদ থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির একজোট হওয়ার কথা।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নেহরুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সনিয়া। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালে কংগ্রেসের সঙ্গ-ছাড়া কারাট সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন প্রতিনিধি পাঠানোর। গোটা দেশে শক্তিহীন হয়ে পড়ার পরে কংগ্রেস সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য দলের ভিতরেই প্রবল চাপ রয়েছে কারাটের উপরে। সিপিএমের একটা বড় অংশেরই মত, কারাটের একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের ফলেই দল এই ভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
এহেন কোণঠাসা অবস্থায় কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখার পক্ষপাতী সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেবরাও তাঁর মতের সমর্থক। দলের রাজনৈতিক লাইনের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ধাক্কা খাওয়ার পরে সম্প্রতি কারাটও ঢোক গিলে বলেছেন, বিজেপি এবং কংগ্রেস দুই দলের নীতিই খারাপ। তবে বিজেপি দেশের পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকর।
এই পরিস্থিতিতে একদা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে থাকা এআইসিসির এক সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য, “বিষয়টি অনেকে এ ভাবে দেখছেন যে কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে জোট করবে, না তৃণমূলের সঙ্গে।
কিন্তু আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই যে, তৃণমূল এবং সিপিএম দুই দলই কংগ্রেসের কাছাকাছি আসতে আগ্রহী।”