নিথর: গুলিবিদ্ধ ‘অবনী’। মহারাষ্ট্র বন দফতরের দেওয়া ছবি।
বাঘকে ‘নিষ্ঠুর ও রক্তলোভী’ বলতে ঘোর আপত্তি ছিল জিম করবেটের। বলেছিলেন, ‘‘বাঘের জন্য জনমত গড়ে না-উঠলে বাঘ লোপ পাবেই। শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে দরিদ্রতর হবে ভারত।’’ মহারাষ্ট্রের ‘মানুষখেকো’ বাঘিনি ‘অবনী’ গত রাতে শিকারির গুলিতে মারা যাওয়ার ২০ ঘণ্টা পরেও সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যাচ্ছে নিন্দায়। লেখা হচ্ছে, ‘‘ঠান্ডা মাথায় খুন করা হল ওকে।’’ দেশের পরিচিত বাঘ বিশেষজ্ঞ উল্লাস করন্থ বলছেন, ‘‘একটা গুলি, আর তাতেই কমে গেল আরও একটি বাঘ। খুব কি দরকার ছিল!’’
দেশের সুপ্রিম কোর্টই বাঁচাতে রাজি হয়নি অবনীকে। মহারাষ্ট্রের যবৎমল জেলার পনঢারকাওড়া এলাকায় গত দু’বছরে ১৩ জন মানুষকে ‘খুনের’ অভিযোগ ছিল অবনীর বিরুদ্ধে। এই এলাকার লাগোয়া টিপেশ্বর ব্যাঘ্র সংরক্ষণকেন্দ্রে দশ মাসের দু’টো ছানা নিয়ে থাকত সে। গত দু’বছর ধরে জঙ্গলের আশপাশ থেকে পাওয়া যাচ্ছিল হাত-পা কাটা, নখের আঁচড় লাগা একের পর এক মৃতদেহ। তার অন্তত পাঁচটিতে অবনীর ডিএনএ-র নমুনা পেয়েছিল বন দফতর। স্থানীয়দের তীব্র ক্ষোভের মুখে অবনীকে দেখা-মাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রধান মুখ্য বনপাল। বন্যপ্রাণ অধিকার কর্মীরা বলেছিলেন, অবনীকে মেরে ফেলা হলে বাচ্চা দু’টোও বাঁচবে না। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, অবনীকে ঘুম পাড়ানো বা অন্য কোথাও সরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে এ ব্যাপারে আর কোনও হস্তক্ষেপ করবে না তারা।
এর পরেও অবনীকে বাঁচানোর জন্য চলছিল প্রচার। অন্য দিকে ‘টি১’ (অবনীর সাঙ্কেতিক নাম)-কে কাবু করতে কার্যত যুদ্ধের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল মহারাষ্ট্রের জঙ্গলে। প্রায় দেড়শো বনকর্মী ও বিশেষজ্ঞ, পুলিশ-কুকুর, হাতি, নাইট ভিশন ড্রোন, অন্তত ৯০টি ক্যামেরা নিয়ে। এমনকি হ্যাং-গ্লাইডারে ঝুলেও জঙ্গলের উপরে চক্কর দিচ্ছিলেন সন্ধানীরা। নিয়োগ করা হয়েছিল শার্প-শুটার। এক পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘হায়দরাবাদের বিতর্কিত শার্প-শুটার নবাব শাফাত আলির ছেলে, আসগর আলি গুলি করে মেরেছেন অবনীকে। শুক্রবার রাতে যবৎমলের রালেগাঁও থানার বোরাতি জঙ্গলের ১৪৯ নম্বর পকেটে ঘটেছে ঘটনাটা।’’
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুয়ায়ী, পাঁচ বছর বয়সি অবনী আর তার বাচ্চাদের বাদ দিলে ওই এলাকায় বাঘ রয়েছে আর মাত্র একটি। সেটি পুরুষ বাঘ। মৃত ১৩ জনের মধ্যে এক
জনের দেহে তারও চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল বলে খবর। বন দফতরের এক কর্তা জানান, অবনীর হদিশ পেতে জঙ্গলে ছড়ানো হয়েছিল অন্য একটি বাঘিনির মূত্র। সঙ্গে কিছু আমেরিকান সুগন্ধীও। যা শুঁকতে শুঁকতে শিকারি দলের কাছাকাছি চলে আসে অবনী।
বন দফতরের একটি সূত্রের দাবি, গত কাল রাত পৌনে বারোটা নাগাদ অবনীর দেখা পেয়ে তাকে প্রথমে ঘুমপাড়ানি গুলি মারেন আসগর। কিন্তু বাঘ তাঁকে আক্রমণ করায় নিজেকে বাঁচাতেই গুলি চালান তিনি। যে ব্যাখ্যা শুনে ভুরু কুঁচকেছে পশুপ্রেমীদের। বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডুর বক্তব্য, ‘‘এই ঘটনা তো নজির হয়ে গেল। এ বার কথায় কথায় বাঘ মারা যাবে!’’
অভিযোগ উঠেছে, এই ধরনের অভিযানের নিয়ম মেনে জঙ্গলে কোনও পশু চিকিৎসককে সঙ্গে রাখেনি বন দফতরের টিম। আসগর আলিকে নিয়েও বিতর্ক কম নয়। পশু অধিকার রক্ষা সংগঠনগুলিরই দাবি, অপ্রয়োজনেও তাঁর গুলিতে মারা গিয়েছে বহু প্রাণী। তাঁদের প্রশ্ন, অবনীর ক্ষেত্রে কি আদৌ ঘুমপাড়ানি গুলি চালিয়েছিলেন আসগর? ‘পেটা’-র ভারতীয় শাখার টুইট, ‘‘দেশের কালো দিন। সম্ভবত বাচ্চাদের সামনেই মারা হয়েছে অবনীকে। এই হত্যাকে বন্যপ্রাণ অপরাধের আওতায় ফেলা হোক।’’ অভিনেতা সিদ্ধার্থ, রবিনা টন্ডনও সরব হয়েছেন টুইটারে।
জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে অবশ্য আজ দিনভর উৎসব। চলছে লাড্ডু বিলি, ফাটছে পটকা।